
ছবি: আপন দেশ
বাংলাদেশের রাজনীতি বড়ই বিচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত- দুই বিপরীত মেরুর দল। ইতিহাসের পরিপূর্ণ প্রতিপক্ষ। একজন স্বাধীনতার নামে রাজনীতি করে, অন্যজন ধর্মের নামে। অথচ সময়-অসময়ে দেখা যায়, এ দুই দলের হৃৎকম্প এক হয়ে যায়। কখনও নির্বাচনের ক্যালকুলেশন, কখনও ক্ষমতায় টিকে থাকার হাহাকার, কখনও আবার নিছক রাজনৈতিক আশ্রয়—সব মিলিয়ে তারা যেন হাত ধরাধরি করে জনগণকে প্রতারিত করার নতুন কৌশল খুঁজে নেয়।
১৯৭১ সালে জামায়াত পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে নিরীহ বাঙালির রক্ত ঝরিয়েছে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস-এ শব্দগুলো আজও বাঙালির মনে ঘৃণার প্রতীক। অথচ সে দলকেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে জোটসঙ্গী করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচন এবং ২৩ সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
সাংবাদিক আবেদ খান প্রশ্ন করেছিলেন- স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে জোট করলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হয়নি? শেখ হাসিনার জবাব ছিল- ‘না, এটা শুধু নির্বাচনী জোট।’ কী আশ্চর্য সাফাই! যেন মুক্তিযুদ্ধ কেবল নির্বাচনী সমীকরণে টেবিলে তোলা এক টুকরো কার্ড।
এরপর ২০০১ সালে বিএনপির চারদলীয় জোটে শরিক হয় জামায়াত। মন্ত্রী হয়, গাড়িতে পতাকা তোলে, রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রভাব বিস্তার করে। সে সময় দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয়। তারপর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে জামায়াতের সাত নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলায়। তখন আওয়াজ ওঠে- ইতিহাসের দায় মিটছে। কিন্তু এ দায় কি আদৌ মিটেছিল, নাকি তখনো তা ছিল রাজনৈতিক নাটক?
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা টানা ক্ষমতায় ছিলেন। গুম, খুন, দুর্নীতি, একদলীয় শাসন- সবকিছু মিলে সরকার স্বৈরাচারের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত হয় দুই হাজারের বেশি মানুষ। এর আগেও সহস্রাধিক নিহত হয়েছে। মরদেহের জন্য পথে পথে ঘুরছে শতাধিক স্ত্রী-সন্তান ও মা।
অবশেষে গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভুত্থানের ঢেউয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়। পুলিশের কর্মকর্তাসহ মন্ত্রীরা হয় আসামি, নয়তো পলাতক। মনে হয়েছিল এ অধ্যায় চিরতরে শেষ। কিন্তু বাংলাদেশি রাজনীতির ইতিহাসে ‘শেষ’ বলে কিছু নেই- বরং বারবার ফিরে আসে একই অনাকাঙ্খিত নাটক।
আজ সেই নাটকই চলছে। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজ জেলায় সমাবেশে ঘোষণা দিলেন- আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন! যে আওয়ামী লীগ গত দেড় দশক ধরে জামায়াতকে ‘যুদ্ধাপরাধীর দল’ বলে গালি দিয়েছে, সে জামায়াতই এখন তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে। বিএনপি যখন মাঠে আওয়ামের বিরুদ্ধে, তখন জামায়াত আওয়ামী লীগের নেতাদের থানা থেকে ছাড়াতে বিক্ষোভ করছে। এ কী অদ্ভুত রাজনৈতিক প্রেম!
আরও পড়ুন<<>> পালানো নেতাদের পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দৌড়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে দেখা গেল আরেক দৃশ্য। ভিপি-জিএসসহ প্রায় সব পদে বিজয়ী হলো ছাত্র শিবির। বিশ্লেষকরা বলছেন- ছাত্রলীগের ভোট গেছে শিবিরের পক্ষে। ছাত্রলীগের পলাতক সভাপতি সাদাদাম হোসেন তো প্রকাশ্যে লিখলেন- “শিবিরের চেয়ে বেটার অপশন নেই।” জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসুতেও একই ফল। রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিছক ভোটের ঘটনা নয়, বরং আওয়ামী লীগ-জামায়াতের অঘোষিত আঁতাতের বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে নতুন প্রজন্ম ক্ষুব্ধ। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, ভারতের আধিপত্যে বিমুখ। তারা ভারতের পণ্য বয়কট করছে। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে। অথচ সে আওয়ামী লীগকেই জামায়াত এখন বুকে টেনে নিচ্ছে। আন্দোলনের সময় বিএনপির মতোই মাঠে থাকা দলটি আজ ক্ষমতার লোভে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করছে। অথচ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছে- ‘আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে।’ ধোঁকাবাজি চরিত্রের চূড়ান্ত উদাহরণ এটি।
শুধু রাজনীতিতেই নয়, বিচার ব্যবস্থাতেও এ সমঝোতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক পুলিশের আইজিপি জুলাই নৃসংশতার মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন। কিন্তু তার স্বপক্ষের আইনজীবী জামায়াত ঘরানার। এমনকি ট্রাইব্যুনালের পিপিও একই মতাদর্শের প্রভাবশালী। জনগণ প্রশ্ন করছে- এ কী কাণ্ড? আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করেছে, জামায়াত ধর্ম নিয়ে। আজ তারা মিলে সাধারণ মানুষকে দ্বিতীয়বার ধোঁকা দিচ্ছে।
আদশর্গত না হলেও আবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়ে যায় কিনা, সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে হবে কি না, এটা বলা কঠিন। উল্লেখ করেছেন গুম, খুনের কথাও।
বিশ্লেষকরা বলছেন- আওয়ামী লীগ ও জামায়াত দুই দলই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং দুই ‘ফেরিওয়ালা’। একজন মুক্তিযুদ্ধের নামে মানুষকে ঠকায়, অন্যজন ধর্মের নামে। ইতিহাস তাদেরকে আলাদা মেরুতে রেখেছে, কিন্তু ক্ষমতার লোভে তারা বারবার একে অপরের বন্ধুতে রূপ নেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিনের কটাক্ষ-‘আওয়ামী লীগ-জামায়াত দুই দলই বাংলাদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজনীতি করে, আর শেষমেশ সেই রক্তকে ব্যবহার করে ক্ষমতার লুঠ ভাগাভাগি করে।’
হাদিসে সতর্ক করে বলা হয়েছে- ‘শেষ জমানায় প্রতারকরা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা সাধু সেজে মানুষের কাছে মিষ্টি কথা বলবে, অথচ হৃদয়ে থাকবে নেকড়ের হিংস্রতা” (তিরমিজী)। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির চিত্র যেন সেই সতর্কবার্তার প্রতিচ্ছবি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জামায়াত ধর্মের চাদর-দুটিই তারা ব্যবহার করছে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে।
তিন দশক পর ফের আওয়ামী লীগ-জামায়াতের সমঝোতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে কলুষিত করছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত, অন্যদিকে ধর্মের শপথ-দুটোই তারা ক্ষমতার লোভে বিসর্জন দিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এ আঁতাত মানতে রাজি নয়। তারা দেখছে- আওয়ামী লীগ-জামায়াত দুই দলই সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করেছে, প্রতারণা করেছে, রক্তকে পুঁজি করেছে। তাই আজ প্রশ্ন উঠছে- এ প্রজন্ম কি আবারও প্রতারিত হলো?
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ অধ্যায় কেবল এক অন্ধকার চিত্র নয়, বরং ভয়াবহ সতর্কবার্তা। আওয়ামী লীগ-জামায়াতের আঁতাত মানে হলো- প্রতারণার নতুন সংস্করণ। এ প্রজন্মের কাছে এর উত্তর একটাই: না, আমরা আর প্রতারিত হব না।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।