Apan Desh | আপন দেশ

পালানো নেতাদের পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দৌড়

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ৮ মে ২০২৫

আপডেট: ২০:০৪, ৮ মে ২০২৫

পালানো নেতাদের পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দৌড়

ছবি: আপন দেশ

বহু দশকের ক্ষমতার রাজনীতি, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির ভারে নুয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। নেত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন, সাংগঠনিক ভাঙন ও জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। দলটি আজ অস্তিত্ব সংকটে। এ শূন্যতা কাজে লাগাতে মাঠে নেমেছে বিএনপি, জামায়াত ও নবগঠিত এনসিপি। শুরু হয়েছে ‘দল পাল্টানোর প্রতিযোগিতা’, চলছে ক্লিন ইমেজ কেনা-বেচা ও পুরোনো নেতাদের পুনর্বাসন। জনমনে প্রশ্ন—আদর্শহীন এ দলবদলের রাজনীতি কাকে জায়গা করে দেবে? এক নতুন শুরু, না পুরোনো প্রহসনের পুনরাবৃত্তি?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতন ঘটে। এদিন শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই নয়; ইউনিট নেতারাও গা ঢাকা দিয়েছেন। সর্বশেষ বুধবার (০৭ মে) মধ্যরাতে বিদেশে পাড়ি জমালেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সারথি। দলীয় সরকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। ৭৫’র সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিহতের পর যেমন আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেয়ার মতো অবস্থা ছিল না। শেখ হাসিনা পালানোর পর এখনকার বাস্তবতাও প্রায় তেমনই।

গত ৫০ বছরে এমন সংকটে পড়েনি আওয়ামী লীগ। এ মুহূর্তে দলের দূরদর্শী বহু নেতা-কর্মী নীরবে দলত্যাগ করছেন, কেউবা অন্য দলে যোগ দেয়ার পথ খুঁজছেন। অন্যরা আছেন দম ধরে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নবউত্থিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য একের পর এক বার্তা ছুড়ে দিচ্ছে। শুরু হয়েছে ‘দল পাল্টানোর’ অলিখিত প্রতিযোগিতা।

বিএনপির বার্তা: ‘দল নয়, দেশ আগে’

গত ৯ জানুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছিলেন, অরাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা অন্য কোনো দলের কাউকে বিএনপিতে যোগদান করানো যাবে না। পতিত সরকারই বিএনপির সহস্রাধিক নেতাকে গুম-খুন করেছে। বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়েই তারা গুমের শিকার। আজও গুম দিবসে রাজপথে সন্তান খোঁজে তার বাবাকে, স্ত্রী খোঁজেন স্বামী। আর সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়েছেন, মারাও গেছেন অনেক মা-বাবা। এসব ভুলে যাচ্ছে দলটির শীর্ষরা।

আরও পড়ুন<<>> আ.লীগ ছেড়ে আসা দেশপ্রেমিকরা যোগ দিতে পারবেন বিএনপিতে: রিজভী

বিএনপি এখন নিজেদেরকে ‘উদার জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম" হিসেবে তুলে ধরছে। ‘না’ ঘোষণার ৫ মাস পর দলের সেই রুহুল কবির রিজভী বৃহস্পতিবার (০৮ মে) এক অনুষ্ঠানে সে বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, দেশ আজ গভীর সংকটে। দেশপ্রেমিক সবাইকে একত্রিত হতে হবে। যারা অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ন্যায়ের পথে চলেছেন, এখন দেশের পক্ষে দাঁড়াতে চান—তাদের জন্য আমাদের দরজা খোলা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধুই কৌশলগত নয়, বরং এক প্রকার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের খেলা। একটি বড় অংশের মধ্যম ও তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের টার্গেট করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ক্লিন ইমেজের অনেক এমপি-নেতার দলটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অভিযোগ আছে- মোটা অঙ্কের বিনিময়ে অনেক নেতা বিএনপির ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন, নিচ্ছেন। 

শত্রুর সঙ্গে মোলাকাত জামায়াতের

একসময় যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ তুঙ্গে ছিল। যুদ্ধাপরাধ মামলায় সংগঠনটির ডজন নেতাকে ফাঁসি দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই জামায়াতে ইসলামী এখন চমকপ্রদভাবে আগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগ ঘরনার নেতাকর্মীদের নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে কুমিল্লা, জামালপুর, গাইবান্ধা, শেরপুসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা জামায়াতে যোগদান করেছেন। তবে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ থেকে আসা ৭ নেতাকর্মীদের তাদের আদর্শেরই বলে দাবি করছে জামায়াত। অর্থাৎ তাদের দলীয় নেতাই বর্ণচোরা হিসেবে আওয়ামী লীগে ছিল। 

গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর সরকারের জুলুম-নির্যাতনের কারণেই আমরা আপনাদের সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারিনি। গণমানুষের কল্যাণে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারিনি। অথচ শুধু মানুষ নয় বরং আল্লাহর সব সৃষ্টিকে সম্মান করা আমাদের দায়িত্ব। মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষের কল্যাণের জন্যই সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই মন্দের বিপরীতে মন্দের চর্চার কোনো সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন<<>> আল্লাহর ওয়াস্তে আ.লীগকে ক্ষমা করে দিলাম: জামায়াত আমীর

কারও প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না আশ্বস্ত করে শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুলুম-নির্যাতন করেছে আমরা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা সংশোধন ও ক্ষমার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তবে কোনো ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার যদি আইনে আশ্রয় নেয়, তাহলে আমরা তাদেরকেও সহযোগিতা করবো। দল হিসেবে আমরা কোনো প্রতিশোধ নেব না। আমরা আদর্শ ডেমোক্রেসীতে বিশ্বাসী। আর আদর্শ ডেমোক্রেসীর মূলমন্ত্রই হচ্ছে যার যার মতো স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার এবং পরমতের প্রতি সহনশীলতা। 

আলাপকালে সংগঠনটির এক কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, যারা সত্যিকারের ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা চান অথচ আওয়ামী রাজনীতিতে ঘেরা ছিলেন, তাদের জন্য আমাদের দাওয়াত এখনো উন্মুক্ত। বহু তৃণমূল নেতা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। 

এ আহবান অনেকে দেখছেন ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে। জামায়াত চাইছে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে, যেখানে বিভ্রান্ত ও দিকহারা আওয়ামীপন্থি নেতারা তাদের শিবিরে আসতে বাধ্য হন।

এনসিপির ভিন্ন কৌশল

নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একেবারে ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত যেখানে ‘সহানুভূতিশীল আমন্ত্রণ’ জানাচ্ছে, তখন এনসিপি প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠাচ্ছে। অন্যদিকে পর্দার আড়ালের বার্তা ভিন্ন। এনসিপির বার্তাটি মূলত ভয়-ভীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়াস। তাদের ব্যাংকিং আছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।

বাহ্যিকভাবে এনসিপির পদে নেই তবে সরকারে আছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভুঁইয়া সজীব। গেলো ডিসি সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগ করেছে, কিন্তু কোন প্রকার অন্যায় এবং গণহত্যা কিংবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা ক্ষমা চেয়ে আবার মেইনস্ট্রিমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।’ তবে এ বক্তব্যের কড়া সমালোচনায় পড়েছিল।

আরও পড়ুন<<>> জাতীয় ঐক্যে ভূমিকা রাখবেন খালেদা জিয়া: জিএম কাদের

ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে আসিফ মাহমুদ বলেন, মূলত ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী আমলের দায় স্বীকার করার কথা বুঝিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদীদের কিংবা আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটাই এখন অবান্তর। ট্রুথ কমিশন কিংবা এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে কীভাবে আওয়ামী লীগের বিষয়টি সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে সরকার কাজ করবে।’
এ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে নিজ জেলা কুমিল্লাতে বিক্ষোভও হয়েছে। আওয়ামী লীগারদের পুনর্বাসনের অভিযোগও আনা হয়েছে। এমনটিও চাউর আছে আসিফ মাহমুদ যথাসময়ে নাহিদ ইসলামের সঙ্গেই মার্চ করবেন।  

এদিকে আওয়ামী লীগকে সব দিক থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি জুলাই আন্দোলনের প্রকাশ্য প্রথম সারির নেতা। এখন যিনি এনসিপির আহবায়ক। 

দেশত্যাগ-দলত্যাগেই স্বস্তি!

আওয়ামী লীগের কার্যালয় বন্ধ। দলটির কার্যক্রম রাজপথ থেকে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে বা নিরব পর্যবেক্ষণে। অনেকে প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন, এ দলে থেকে আর কিছু হবে না। কারাগার থেকে আদালত চত্বরে কেঁদেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। বলেছেন, বাকি জীবনে আর আওয়ামী লীগ করবেন না। 

রাজনীতির মাঠে এ ধরনের পলায়নপর অবস্থা দেখা গেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। তবে এবার যেটি ব্যতিক্রম—তা হলো, আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে ম্লানের দিকে হাঁটছে। পুরোনো বিরোধীরা সুযোগ নিচ্ছে।

জনগণের চোখে প্রশ্ন: আদর্শ নাকি স্বার্থ?

রাজনৈতিক দলবদল বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে এবার ব্যাপারটা বেশি নগ্ন ও স্পষ্ট। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছে—এতদিন যাঁরা লুটপাট করলেন, এখন তারা কোন মুখে আবার ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্ম’, কিংবা ‘জাতীয় ঐক্য’র কথা বলবেন? বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। অনেকেই বলছেন,দল বদলালে চরিত্র বদলায় না। আগে আওয়ামী লীগ করে খেয়েছে, এখন বিএনপি-জামায়াত। ব্যাংক, বীমাসহ দখল, চাঁদাবাজি হচ্ছেই; তবে বদল হয়েছে শুধু হাত। তারা ক্ষমতায় গিয়ে দেশ বাঁচাবে—এ নাটক আর কতদিন?

দলীয় শৃঙ্খলার অভাব, নৈতিক ভিত্তিতে ধ্বংস এবং জনগণের ঘৃণা—এ ত্র্যহস্পর্শে এখন ঘিরে ধরেছে আওয়ামী লীগকে। এক সময়ের রাষ্ট্রক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী দলটি আজ নিজের তৈরি কাঠগড়ায়। আইন প্রণেতারা হাতকড়া পড়ে এজলাসে। ধাওয়া দিচ্ছে জনতা। আর এ অবস্থায় বিরোধীরা শুধু ‘প্রতিশোধ’ নয়, ‘প্রতিস্থাপন’-এর পথে হাঁটছে। সে পথেই হাঁটছেন বহু সাবেক আ.লীগার। ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শের অভাব, চরিত্রহীন দলবদল এবং জনতার প্রত্যাখ্যান—এ ত্রিমুখী সংকট থেকেই কি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম হবে, নাকি পুরোনো শকুনেরাই নতুন চেহারায় ফিরে আসবে—তা সময়ই বলবে।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়