
শাহাদাত হোসেন সেলিম
বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে ভাড়াটে চরিত্রের অভাব নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এক নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে- শাহাদাত হোসেন সেলিম। নামসর্বস্ব বাংলাদেশ এলডিপি নামের ক্ষুদ্র অংশের নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপির ১২ দলীয় জোটে শরিক হয়ে তিনি হয়েছেন ‘বড় নেতা’। কিন্তু আসল খেলাটা অন্য জায়গায়।
বিএনপির ভেতরে থেকে তিনি আওয়ামী লীগ ও ভারতের ‘র’-এর হয়ে কাজ করেছেন বহু আগে থেকেই। মুখে বিরোধী জোটের মুখপাত্র, অন্তরে নিকট ক্ষমতাসীনদের গুপ্তচর-এ দ্বিমুখী চরিত্রই তাকে বিএনপির ভেতরে এক ভয়ঙ্কর টাইম বোমাতে পরিণত করেছে।
নামসর্বস্ব দলের ভিড়, ভাড়াটে নেতার কারখানা
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সমমনা দলগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে আন্দোলনের শক্তি বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবতা হলো- জোটে ভিড় জমাল এমন সব নামসর্বস্ব দল, যাদের না আছে জনসম্পৃক্তি, না আছে ভোটে জেতার সামর্থ্য।
বিএনপি ছাড়া এ জোটের বাকি দলের নাম সাধারণ মানুষ জানেই না। অফিস নেই, কর্মী নেই, ব্যানার ধরার লোক ভাড়ায় আনতে হয়- এমন দলই ভরে ছিল তথাকথিত ১২ জোটে। মোস্তফা জামাল হায়দার, সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, সৈয়দ এহসানুল হুদা, কেএম আবু তাহের, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, মহিউদ্দিন ইকরাম, আব্দুর রকীব, তাসমিয়া প্রধান, নূরুল ইসলাম, আবুল কাসেম-এসব নাম মানুষের মুখস্থ নেই। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বকে ভরসা করিয়ে এরা বড়সড় মঞ্চ, আলোচনার টেবিল আর গণমাধ্যমে জায়গা দখল করেছেন। এদের ভিড়েই ছিলেন শাহাদাত হোসেন সেলিম। আর তিনি শুধু টিকে থাকেননি, জোটের মুখপাত্রের পদেও বসেছিলেন। এখান থেকেই শুরু তার দ্বিমুখী খেলা।
গুপ্তচরের খেলায় আন্দোলন ভেস্তে
প্রশ্ন জাগে- কেন বিএনপি ১৬ বছর ধরে ধারাবাহিক আন্দোলনে ব্যর্থ হলো? কেন প্রতিবার গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা ধসে পড়েছে? উত্তরটার আংশিক লুকিয়ে আছে এ ভাড়াটে শরিকদের ভেতরে। জোটের আসনে বসে থেকেই অনেকে আওয়ামী লীগ কিংবা ভারতের কাছে তথ্য পাচার করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত নাম হলো শাহাদাত হোসেন সেলিম। বিএনপির গোপন কৌশল, আন্দোলনের পরিকল্পনা- সবকিছুই তিনি নিয়মিত পাচার করেছেন। ফলে বিএনপি যখন রাস্তায় নামতে চেয়েছে, তখনই তা ভেস্তে গেছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই সরকার জানত বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপ কী। এ বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
‘কোন মুসলমানের পক্ষে বিএনপি করা সাজে না’-সেলিমের অতীত স্বরূপ
শাহাদাত হোসেন সেলিম ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর তিনি চট্টগ্রামের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পার্টি এনডিপিতে যোগ দেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দিলে সেলিমও বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক হন। তখন মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। ২০০০ সালে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন সেলিম।
আরও পড়ুন<<>> রামগঞ্জ বিএনপির জন্য হুমকি এলডিপির সেলিম!
এখন তিনি বিএনপির জোটসঙ্গী। অথচ ২০০৬ সালে কর্নেল (অব.) অলির সঙ্গে লিবারেল ডেমোকেটিক পার্টিতে (এলডিপি) যোগ দিয়ে সেলিম প্রকাশ্যে বলেছিলেন- ‘কোন মুসলমানের পক্ষে বিএনপি করা সাজে না।’ কেবল তাই নয়, তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান সম্পর্কেও অশোভন, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। প্রশ্ন হলো- যে ব্যক্তি একসময় বিএনপিকে ধর্মবিরোধী বলে গাল দিয়েছিল, সে কীভাবে আজ বিএনপির শরিকদলের মুখপাত্র হয়ে ওঠে? উত্তর সহজ-এটাই ভাড়াটে চরিত্রের রাজনীতি। যেখানে টাকা, সুবিধা আর সুযোগ আছে, সেখানেই সেলিমের আনুগত্য। তার অতীতই প্রমাণ করে তিনি বিএনপির প্রতি কোনোদিনই আন্তরিক ছিলেন না।
ভোটে শূন্য, ধান্ধায় শতভাগ
শাহাদাত হোসেন সেলিমের দল এলডিপির ভগ্নাংশ। এ দলের না আছে সাংগঠনিক ক্ষমতা, না আছে ভোটের মাঠে শক্তি। চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। অথচ বিএনপির ছায়ায় থেকে তিনি হয়েছেন ‘বড় নেতা’। রাজপথে কর্মী জোগাড় করতে না পারলেও, সেলিম জানেন কোথায় দাঁড়িয়ে কীভাবে প্রচার পেতে হয়। তিনি ব্যবহার করেছেন বিএনপিকে কেবলমাত্র ধান্ধার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। আন্দোলনের সময়ে বিএনপির মঞ্চে ভিড়েছেন, ১২ দলীয় জোটের গণমাধ্যমে মুখপাত্র হয়েছেন, কিন্তু অন্তরে কাজ করেছেন বিএনপির ক্ষতি করার জন্য।
আরও পড়ুন<<>> ন্যাশনাল লাইফের তদন্তে দুদক: ২১শ’ অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন, ৭১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ-পাচার
খুলে গেল মুখোশ
বিএনপি তখন আগাম নির্বাচনের দাবি তুলছে। তাদের অবস্থান ছিল-অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে সেলিম হঠাৎ বলে বসলেন-‘বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।’ যে কথা বিএনপি কখনো বলেনি। বরং তারা স্পষ্টভাবে বলেছিল নির্বাচন হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। তাহলে সেলিম কেন ভিন্ন সুর তুললেন? উত্তর একটাই- তিনি আসলে খেলছিলেন আওয়ামী লীগের মাঠে। মুখপাত্রের চেয়ারে বসে বিরোধী জোটের বার্তা বিকৃত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
সেলিম কোন গোলপোস্টে গোল দিচ্ছেন?
রাজনীতির খেলায় গোল দিতে হয় প্রতিপক্ষের জালে। কিন্তু সেলিমের মতো ভাড়াটেরা নিজের দলের জালেই বল ঢুকিয়েছে বারবার। মুখে বিএনপি, অন্তরে আওয়ামী লীগ। তিনি আসলে ক্ষমতাসীনদের কৌশলের অংশ হয়েই কাজ করেছেন। এমনকি দলের ভেতরে বিভ্রান্তি ছড়ানো, আন্দোলন ভাঙা, ভেতরের তথ্য পাচার- সব মিলিয়ে তার ভূমিকাই বিএনপির ব্যর্থতার একটি অন্যতম বড় কারণ।
বিএনপির ভেতরে বসানো টাইম বোমা
শাহাদাত হোসেন সেলিম এখন বিএনপির ভেতরে এক ‘টিকিং টাইম বোমা’। যেকোনো সময় তার মন্তব্য, বিএনপির নেয়া কর্মসূচি কিংবা গুপ্তচরবৃত্তি বিএনপিকে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। হিসাব কষলে সেলিম বিএনপির জন্য কোনো সম্পদ নন, তিনি এক ভয়ঙ্কর বোঝা। আন্দোলনের নামে ভেতর থেকে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। লক্ষীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভরাডুবি ঘটিয়েছেন। আসনটি শুধু হাতছাড়া হয়নি, বরং সেখানে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্থানীয় নেতাদের আক্ষেপ-‘ধানের শীষ প্রতীকে ভাড়াটে নেতাকে দাঁড় করানো মানে আসন ধ্বংসের সমান।
শাহাদাত হোসেন সেলিমের অবধ্য হয়ে রামগঞ্জের অনেক বিএনপিনেতা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, নি:স্ব হয়েছেন হামলা-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ওদিকে সেলিম ঠিকই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সখ্যতায় দিনাতিপাত-ব্যবসাবাণিজ্য করেছেন। মাফিয়া শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাছিম, তার ভাই জালাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের তার ব্যবসায়িক পার্টনার। যার প্রমাণ আপন দেশ-এর হাতে এসেছে।
শাহাদাত হোসেন সেলিমের অতীত, বর্তমান আর কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই স্পষ্ট- তিনি বিএনপির ঘরে বসানো এক বোমা। মুখে বিরোধী, অন্তরে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন। তার মতো চরিত্রদের জোটে রাখলে বিএনপির কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতি বহুগুণ। বিএনপি কি সময় থাকতে এ বোমা নিস্ক্রিয় করবে, নাকি বুকে বেঁধে রেখে নিজেই ধ্বংসের ঝুঁকি নেবে-এমন প্রশ্ন দল ও জোট নেতাদের।
মন্তব্য জানতে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কখনই ব্যবসায়িক পার্টার ছিল না।
(আরও বিস্তর মঙ্গলবারের প্রতিবেদনে)
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।