
প্রতীকী ছবি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হঠাৎ আলোড়ন তুলেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক।
বৈঠক শেষে প্রবাসীরা ইংরেজিতে বলেছেন, ‘ডিল ডান’। যার বাংলা সমঝোতা বা আলোচনা বা সিদ্ধান্ত পাক্কা। এ খবরে বিএনপি নেতাকর্মীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে।
এদিকে বৈঠক ঘিরে নতুন করে রাজনীতির মাঠে আলোচনা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে এ সম্পর্কের গভীরতা যদি আরও বাড়ে, তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেতে পারে বিএনপির দীর্ঘদিনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, জামায়াতে ইসলামী।
প্রশ্ন উঠছে—তবে কি আদর্শিক ও কৌশলগত দিক থেকে বিএনপি জামায়াতকে ঝুঁকিতে ফেলছে? জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান, ভোটব্যাংক ও পূর্ববর্তী আসনভিত্তিক শক্তি বিশ্লেষণ করে যদি বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করা হয়, তাহলে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যাকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিএনপি-ইউনূস সম্পর্ক, জামায়াতের কৌশলগত দুর্ভাবনা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্তর্বর্তী সরকার মানে ‘তৃতীয় শক্তি বা প্লটফর্ম’। বিশেষ করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতা অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে বসেছে, তা ছিল চমকপ্রদ। এ বৈঠক বেশ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় একটি নির্বাচনী রূপরেখা খুঁজছে—যা কৌশলগত দিক থেকে সময়োচিত হলেও জামায়াতের জন্য তা মোটেও সুখবর নয়।
কারণ—ড. ইউনূস বরাবরই জামায়াতের বিরুদ্ধে মত পোষণকারী একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে গঠিত সরকার যদি একটি আধুনিক, উদার ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে, তবে সেখানে জামায়াত নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকেই যাবে।
ফলে বিএনপির যদি ড. ইউনূস প্রশাসনের সঙ্গে গভীর সমঝোতা গড়ে ওঠে, তাহলে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে একপ্রকার 'অপ্রয়োজনীয়' হয়ে পড়তে পারে।
জামায়াতের আদর্শিক বাধা ও চিত্র
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে সংগঠিত দল। তবে তাদের আদর্শিক অবস্থান—যা মূলত ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে ২০১৩ সালের শাহবাগ গণআন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর থেকে জামায়াত একটি ঘৃণিত রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। অবশ্য ২০২৪ সালের আন্দোলনে তাদের ভুমিকা বেশ আলোচনার।
জামায়াতের নির্বাচনী নিবন্ধন ২০১৩ সালে বাতিল হয়। পরবর্তী সকল জাতীয় নির্বাচনে তারা প্রার্থী দিতে পারেনি দলীয় পরিচয়ে। ফলে, জামায়াত একটি ‘ছায়া রাজনৈতিক সত্তা’তে পরিণত হয়েছিল। যার আদর্শিক অবস্থান বিএনপি’র চাইতেও বেশি রক্ষণশীল। অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
জামায়াতের ভোটব্যাংক ও অতীতের আসনভিত্তিক বিশ্লেষণ
ভোটের হার: জামায়াতের সংগঠিত ভোটব্যাংক অতীতে কখনো ৮%-এর বেশি হয়নি। সাধারণত ৪%–৬% এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। তবে এটি ছিল ঘনীভূত ও বিশ্বস্ত ভোটার, যারা আদর্শিক কারণে ভোট দেয়।
২০০১ সালের সাফল্য : জামায়াত সবচেয়ে ভালো ফল পায় ২০০১ সালের নির্বাচনে—১৭টি আসনে জয়। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের অংশ হয়ে তারা পায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও। সে নির্বাচনে তারা প্রায় ১৬ লাখ ভোট পায়।
২০১৮ সালের বাস্তবতা: নিবন্ধন না থাকায় ‘স্বতন্ত্র’পরিচয়ে প্রার্থী দিয়ে কোথাও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি জামায়াত। তবে কোথাও কোথাও তারা ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ পর্যন্ত ভোট পেয়েছে—বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর কিছু এলাকায়।
বিকল্পের খোঁজে বিএনপি
বিএনপি এখন একটি 'ক্লিন ইমেজ' নির্মাণের চেষ্টায়। একদিকে তারা তরুণ ভোটার টানতে চায়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জন করতে চায়।
বিএনপি এখন চায় একটি ‘ক্লিন ইমেজ’। তারা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে চায়, তরুণদের আকৃষ্ট করতে চায়। তাই জামায়াতকে সঙ্গী করা তাদের জন্য রাজনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তার ওপর জামায়াত যে একমাত্র ইসলামি শক্তি নয়, সেটিও এখন স্পষ্ট। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই), হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটসহ অনেকেই এখন আলাদাভাবে ইসলামি রাজনীতিতে অবস্থান গড়েছে। জামায়াত সেখানে একঘরে। তাই নিষ্কন্টক বিকল্পদের পাত্তা দিচ্ছে বিএনপি।
জামায়াতের সামনে দুই পথ
বিএনপির সঙ্গে গোপন সমঝোতায় আসন ছাড় নেয়া। অন্য আসনে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে ‘ভোট ট্রান্সফার করা। যা ২০১৮ সালেও করেছিল। এতে জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারলেও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্বীকৃতি পাবে না।
অন্যদিকে বড় ছাড় দিয়ে অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠন বা দলগুলোর সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করা। নতুন রাজনৈতিক ব্যানার ব্যবহার করে তরুণ নেতৃত্ব দিয়ে পুনরুদ্ধার চেষ্টা। কিন্তু আদর্শগত প্রশ্নে এ রূপান্তর কঠিন। সংগঠনের ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের জন্য জায়গা আছে। কিন্তু জামায়াত কি সেই স্থান ধরে রাখতে পারবে? আদর্শ, অতীত ইতিহাস, ও বর্তমান বাস্তবতা বলছে— রাজনৈতিক পরিসরে ক্রমশ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। তাদের ফিরে আসার পথ সংকুচিত।
বিএনপির নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রে জামায়াতের জায়গা সীমিত। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, নির্বাচনী পরিকল্পনা ও পশ্চিমা শক্তির সমর্থন—সব মিলিয়ে জামায়াত এখন রাজনৈতিকভাবে ‘অপ্রয়োজনীয় পার্টনার’।
পরিণতি স্বাভাবিক—নাম থাকবে, অস্তিত্ব থাকবে, কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার স্বপ্ন মরে যাবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।