প্রতীকী ছবি
স্বপ্ন মানব জীবনের এক রহস্যময় অধ্যায়। এ স্বপ্ন কখনো আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে, আবার কখনো তা মানুষকে চিন্তিত ও বিস্মিত করে তোলে। বিশেষ করে স্বপ্নে কোনো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় দেখা—এটি অনেকের মনে প্রশ্ন জাগায়— এর অর্থ কী? ইসলাম স্বপ্নকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেনি; বরং কুরআন ও হাদিসে স্বপ্নের গুরুত্ব ও তার বিভিন্ন প্রকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখার ব্যাখ্যা কী—সে বিষয়েই এ সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যনির্ভর আলোচনা তুলে ধরা হলো—
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বপ্নের প্রকারভেদ
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করেছেন—
১. রুইয়ায়ে সালিহা: সৎ বা সত্য স্বপ্ন— যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ বা সতর্কবার্তা হিসেবে আসে।
২. হাদিসুন নাফস: মনের কল্পনা— দিনের চিন্তা-ভাবনা বা অবচেতনের প্রতিফলন।
৩. হুলুম: শয়তানের পক্ষ থেকে— যা ভয়, অস্থিরতা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখা— প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এ তিনটির যেকোনো একটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা
১. মৃত ব্যক্তির ভালো অবস্থার ইঙ্গিত
যদি স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে হাসিখুশি, সুস্থ ও প্রশান্ত দেখা যায়, তবে অনেক আলেমের মতে এটি তার পরকালীন ভালো অবস্থার ইঙ্গিত হতে পারে। কুরআনে শহীদদের সম্পর্কে বলা হয়েছে— بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ
‘বরং তারা জীবিত, তাদের রবের কাছে রিজিকপ্রাপ্ত।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৬৯)
যদিও এ আয়াতটি শহীদদের জন্য, তবে সাধারণভাবে ভালো অবস্থার একটি ইঙ্গিত হিসেবেও আলেমরা এ ধরনের স্বপ্নকে দেখেছেন।
২. কোনো বার্তা বা উপদেশের ইঙ্গিত
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তি যদি কিছু বলে, উপদেশ দেয় বা কোনো কাজের প্রতি ইঙ্গিত করে—তাহলে সেটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশেষ করে যদি কথাগুলো শরিয়তসম্মত হয়, যেমন—নামাজ, সদকা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ইত্যাদি।
তবে মনে রাখতে হবে, স্বপ্ন কখনো শরিয়তের দলিল নয়; কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী কোনো বিষয় স্বপ্নে এলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেক সময় প্রিয় কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য গভীর ভালোবাসা, শোক বা স্মৃতিচারণার কারণে এমন স্বপ্ন দেখা যায়। এটি তখন ‘হাদিসুন নাফস’—অর্থাৎ মনের ভাবনারই প্রতিফলন। এর আলাদা কোনো গায়েবি অর্থ না-ও থাকতে পারে।
৪. স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখার ব্যাখ্যা সম্পর্কে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকার প্রখ্যাত তাবেয়ি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, যদি (অর্থবহ) স্বপ্নে কেউ মৃত ব্যক্তিকে (জীবিত) দেখে তাহলে তাকে যে অবস্থায় দেখবে সেটাই বাস্তব বলে ধরা হবে। তাকে যা বলতে শুনবে, সেটা সত্যি বলে ধরা হবে। কারণ, সে এমন জগতে অবস্থান করছে যেখানে সত্য ছাড়া আর কিছু নেই। যদি কেউ মৃত ব্যক্তিকে ভালো পোশাক পরা অবস্থায় বা সুস্বাস্থের অধিকারী দেখে, তাহলে বুঝতে হবে সে ভালো অবস্থায় আছে। আর যদি জীর্ণ, শীর্ণ স্বাস্থ্য বা খারাপ পোশাকে দেখে তাহলে বুঝতে হবে, ভালো নেই। তার জন্য তখন বেশি করে মাগফিরাত কামনা ও দোয়া করতে হবে। (তাবিরুর রুইয়া লিইবনি সিরিন)
আরও পড়ুন<<>>অমুসলিমের হক নষ্ট করলে যে পরিণতি
৫. দোয়া ও সদকার তাগিদ
কিছু আলেম বলেন, স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখা তার জন্য দোয়া ও সদকার প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত হতে পারে। বিশেষ করে যদি তাকে দুর্বল, কষ্টে বা নীরব অবস্থায় দেখা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি জিনিস ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান; যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম ১৬৩১, তিরমিজি ১৩৭৬, নাসাঈ ৩৬৫১, আবু দাউদ ২৮৮০,৩৫৪০, মুসনাদে আহমাদ ৮৬২৭, দারেমি ৫৫৯, রিয়াদুস সালেহিন ২/৯৫৬)
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
প্রতিটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক রকম হয় না; ব্যক্তি, সময় ও পরিস্থিতিভেদে অর্থ ভিন্ন হতে পারে। স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে আকিদা, শরিয়ত বা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া অনুচিত। তবে ভীতিকর স্বপ্ন হলে বাম দিকে হালকা থুথু ফেলে ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা সুন্নাহ।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখার দুটি ঘটনা
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত বিদ্রোহীরা যখন ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের (রা.) বাসভবন ঘেরাও করল, তখন ওসমান (রা.) একদিন বলেন- আমি গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ওসমান আমাদের সঙ্গে তুমি ইফতার করবে। ওই দিনই ওসমান (রা.) শহীদ হলেন। (আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া)
হজরত আনাস ইবন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, আবু মুসা আশআরী (রা.) একদিন আমাকে বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি একটি পাহাড়ের কাছে গিয়েছি, পাহাড়ের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রয়েছেন আর পাশে আবু বকর (রা.)। আবু বকর (রা.) তার হাত দিয়ে ওমরের (রা.) দিকে ইশারা করছেন। আমি আবু মুসার (রা.) এ স্বপ্নের কথা শুনে বললাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! ওমর (রা.) তো মারা যাবেন! আপনি কি এ স্বপ্নের কথা ওমরকে (রা.) লিখে জানাবেন? আবু মুসা (রা.) বললেন, ওমর (রা.) বেঁচে আছেন, আমি কীভাবে তাকে তার মৃত্যুর সংবাদ দেব!কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বপ্নটা সত্যে পরিণত হয়। হজরত ওমর (রা.) শহীদ হন। (আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া)
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখা—এটি কখনো সুসংবাদ, কখনো উপদেশ, আবার কখনো কেবল মনের গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বপ্নকে সম্মান দেয়া হলেও তাকে চূড়ান্ত সত্য বা বিধানের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। তাই এমন স্বপ্ন দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা, মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও সদকা করা এবং নিজের আমল সংশোধনের দিকে মনোযোগ দেয়াই একজন মুমিনের জন্য সর্বোত্তম পথ।
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































