Apan Desh | আপন দেশ

আওয়ামী-আলতাফ সিন্ডিকেটে বন্দি শিক্ষা প্রকৌশল!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:২৩, ২৮ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ২০:১০, ২৮ জুলাই ২০২৫

আওয়ামী-আলতাফ সিন্ডিকেটে বন্দি শিক্ষা প্রকৌশল!

ছবি: আপন দেশ

শিক্ষা প্রশাসন এখন যেন রাজনৈতিক চোরাগলি আর আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির অভয়ারণ্য। মাফিয়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে চলছে জামায়াত-আওয়ামী দোসরদের একচ্ছত্র দাপট। প্রধান প্রকৌশলী পদে বসা আলতাফ হোসেন হয়ে উঠেছেন এ সিন্ডিকেটের কাণ্ডারি।

১৯ জানুয়ারি, সিনিয়রদের উপেক্ষা করে চরম অব্যবস্থাপনা আর প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের মধ্য দিয়ে নবম মেধাক্রমধারী প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনকে প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়। মেধাক্রমে তার আগে থাকা প্রকৌশলী মেনহাজুল হক ও তারেক আনোয়ার জাহেদিকে পাশ কাটিয়ে এ দায়িত্ব তাকে দেয়ার মূল কারিগর ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের।

সচিব সিদ্দিক জোবায়ের দাবি করেছেন, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের প্রত্যক্ষ সুপারিশে এ নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ভেতরের কর্মকর্তারা আলতাফ হোসেনকে জামায়াতপন্থী বলেই চিহ্নিত করেন। পাহার ঠেলে এ নিয়োগ হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে।

তবে কিছুদিন পরই ফেসবুকের বাতাসে আলতাফ হোসেনের ঘোমটা উড়ে প্রকাশ পায়  আসল চেহারা। একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায়, তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন বগুড়ার সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাতে আওয়ামী প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। এমন বক্তৃতা যে কোনো দলে হিংসার উদ্রেক করতে পারে। 

ভিডিওতে তিনি বলছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি তবে এখন প্রশাসনিক যে কলম হাতে আছে তা নিয়েই লড়াই করব। যারা আমাদের দেশকে মধ্যযুগের বানাতে চায়, পাকিস্তানি রাষ্ট্র বানাতে চায়, আমাদের ছেলে-মেয়েদের ইসলামের মোড়ক পরিয়ে জঙ্গি বানাতে চায় সে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার যে রায় দিয়েছে তা সমুন্নত রাখতে কাজ করে যাব। দেশ বিরোধী চক্রান্তকারীদের মুলোৎপাটন করব’। আওয়ামী লীগের সময় দীর্ঘ ৮ বছর বগুড়া জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন এ আলতাফ হোসেন। যে সময় অন্যমতাদর্শের ঠিকাদারগণ কাজ তো দুরের কথা তার দফতরেই নিষিদ্ধ ছিল। ওই সময় তিনি বিভিন্ন এমপির সভায় গিয়েছেন, দলীয় নেতার মতোই বক্তব্য দিয়েছেন। 

এ দ্বিচারিতা এবং সুবিধাবাদী অবস্থান একদিকে প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে, অন্যদিকে একটি গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সন্দেহও তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠছে—আলতাফ হোসেন কি জামায়াতের চাহিদা পূরণে আওয়ামী লীগের মুখোশ পরে ছিলো, না কি উল্টোটা?

আরও পড়ুন<<>> ছয় সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে ইইডির প্রধান হলেন প্রকৌশলী আলতাফ

আরও বিতর্ক জন্মায় যখন দেখা যায়, আলতাফ নিজের পদকে শক্তিশালী করতে শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহিদুলের মাধ্যমে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের নাম ভাঙিয়ে তদবির চালাচ্ছেন। এর ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার সকল অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার বিদায় হলেও প্রশাসনের কঙ্কালগাত্রে এখনো সেই নখদাঁত বিদ্যমান।

তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর একের পর এক অবৈধ পদোন্নতির নজির তৈরি করেন।

বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সাবেক মন্ত্রীর ভাগ্নে মীর মুয়াজ্জেমকে অযোগ্যভাবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সিরাজুল ইসলামকে পুরস্কার স্বরূপ নির্বাহী প্রকৌশলী বানানো হয়। একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী শিকদারকে সেইফ এক্সিট দিয়ে সাভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পদায়ন করা হয়। সেখানেও তিনি গড়ে তুলেছেন দলীয় নেতাদের অভয় আশ্রম।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা বিদ্যুৎ প্রকৌশলী জরজিসুর রহমানকে যান্ত্রিক নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি—যেখানে তার বিভাগ, অভিজ্ঞতা ও মেধাক্রম কোনো শর্তই পূরণ করে না। সাত বছরের অভিজ্ঞতা লাগে সেখানে তার অভিজ্ঞতা মাত্র সাড়ে ৫ বছর। 

এ প্রসঙ্গে জরজিসুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার অভিজ্ঞতা হয়নি বলেই চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এ সকল পদোন্নতির পেছনে লেনদেন হয়েছে কোটি অঙ্কের টাকা। আর অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবিরের ছত্রছায়া ছিল বলে অভিযোগ। আর দফতরে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে অঘোষিত দায়িত্ব (ক্যাশিয়ার-কমিশন) দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের আরেক নেতা আসাদুজ্জামানকে। 

শুধু প্রশাসনিক নয়, ঠিকাদারিতে চলছে ‘লাইসেন্স বাণিজ্য’।

দিনাজপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহ আলমের মালিকানাধীন মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ এখনো দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় একচেটিয়া কাজ পাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—হুইপ ইকবালুর রহিমের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে তিনি লাইসেন্স ভাড়া বাবদ শতকরা ২ টাকা আদায় করছেন, যার বড় অংশই রাজনৈতিক ফান্ডে যাচ্ছে। সিন্ডিকেটে আরও আছে মেসার্স সৈকত এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স বসুন্ধরা হাউজ বিল্ডার্স। এদের মাধ্যমে আওয়ামী আমলের অনেক প্রকৌশলীর কাছে চাপ সৃষ্টি করে কাজ ভাগিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনো সে ধারা অব্যাহত।

প্রকৌশলী সূত্র জানায়, এ তিন ঠিকাদারকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য জেলার বৈধ ও যোগ্য ঠিকাদারদের কাজ বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রকৌশলী বদলি পর্যন্ত হয়েছে এ ঠিকাদারদের কথায়।

বিস্ময়ের বিষয়, যেখানে সরকার ব্যয় সংকোচন ও দুর্নীতি দমন নিয়ে কঠোর হচ্ছে, সেখানে আলতাফ হোসেন সম্প্রতি দেড় ডজন গাড়ির বহর নিয়ে দেশ চষে বেড়িয়েছেন। জেলা-উপজেলার প্রকৌশলীদের কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। এ বিষয় নিয়ে অধস্তনদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।

আরও পড়ুন<<>> শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান, হর্ষে আগমন বিষাদে বিদায়

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এখন কোনো নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও আমলাতান্ত্রিক দালালদের ঘাঁটি।

প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষায়, অবিলম্বে এ ধরণের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তদন্ত ও শুদ্ধি অভিযান চালানো এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় শিক্ষা কাঠামো হবে আমলাতন্ত্রের জিম্মি আর জনসেবার বদলে দলীয় স্বার্থ রক্ষার মঞ্চ।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনকে ০১৭১২-----২৩ নম্বরে গত ১৫ দিনের দৈনিক একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা দিলেও তাতে সাডা দেননি।   

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়