Apan Desh | আপন দেশ

পিআর পদ্ধতি: অধিকার না ফাঁদ?

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ৫ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৪:৪৭, ৫ জুলাই ২০২৫

পিআর পদ্ধতি: অধিকার না ফাঁদ?

ছবি: আপন দেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি গভীর প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে: আমরা কী এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা চাই, যেখানে জনগণের ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে, নাকি আমরা সেই পুরনো রেওয়াজে চলতে থাকব, যেখানে ‘দলীয় প্রতীকে ভোট’ মানে কার্যত নিজের জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া? এ প্রসঙ্গে নতুন করে আলোচনায় এসেছে পিআর বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি। পিআর পদ্ধতিকে কেউ কেউ পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দেয়াল বলছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে ভোটারের অধিকার খর্ব করার এক নতুন ফাঁদ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বাস্তবতা কি এত সরল?

পিআর পদ্ধতির ধারণা: কী, কেন, কিভাবে?

পিআর বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো, একটি রাজনৈতিক দল সংসদে আসন পাবে সেই অনুপাতে, যত ভোট তারা পেয়েছে। অর্থাৎ, যদি কোনো দল মোট বৈধ ভোটের ৩০% পায়, তবে তারা ৩০% সংসদীয় আসনে প্রতিনিধিত্ব পাবে। এতে করে প্রত্যেক ভোটের মূল্য প্রায় সমান হয়ে ওঠে এবং ছিটকে পড়া ক্ষুদ্র দলগুলোরও সংসদে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়। তাত্ত্বিকভাবে, এটি একটি বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু এ পদ্ধতিরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে সাধারণ ভোটার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারে না—তাকে একটি দলকে ভোট দিতে হয়। এরপর সেই দল দলীয় তালিকা অনুযায়ী সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেয়। এ তালিকা প্রণয়ন নিয়ে স্বচ্ছতা ও দলীয় গণতন্ত্রের ঘাটতির আশঙ্কা থেকেই যায়। ফলে অনেকেই মনে করেন, এ পদ্ধতিতে প্রকৃত জনমত যেমন প্রতিফলিত হয়, তেমনি দলীয় সিন্ডিকেটের হাতেও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বাংলাদেশে ভোটার-প্রার্থী সম্পর্ক: একটি বঞ্চিত বাস্তবতা

বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যকার সরাসরি সম্পর্ক একটি বড় শক্তি। একজন ভোটার জানেন, তার ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বাড়ি কোথায়, কাজ কী, এলাকার উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রেখেছেন। নির্বাচনের সময় ওই ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাইতে হয়, প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, ভুলের জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে এ সম্পর্ক ভেঙে যায়। ভোটার শুধু একটি দলকে ভোট দেয়, আর দলই সিদ্ধান্ত নেয় কে হবেন সংসদ সদস্য। এতে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য দলীয় অনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতার নৈকট্য—এসবই হয়ে ওঠে মূল নির্ধারক। দলীয় স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের পুনর্বাসনের পথও উন্মুক্ত হয়।

এ প্রসঙ্গে একাধিক সাধারণ ভোটার প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমার ভোট আমি দেব, পছন্দের প্রার্থীকে দেব। কিন্তু যদি আমি জানিই না কে হবেন আমার প্রতিনিধিত্বকারী এমপি, তবে আমি ভোট দিচ্ছি কাকে?’ এ প্রশ্নই আমাদের গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটকে উন্মোচন করে।

পিআর পদ্ধতির ইতিবাচক দিক, ত্রুটি ও দুর্বলতা

পিআর পদ্ধতির পক্ষে যারা, তাদের যুক্তি—বর্তমান একক-আসনভিত্তিক ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে অনেক সময় মোট ভোটের সামান্য একটি অংশ পেয়েও দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। এটি প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি দল ৪০% ভোট পেয়ে ৬০-৭০% আসন দখল করছে। পিআর পদ্ধতিতে এ বৈষম্য কমে আসে। ছোট দলগুলো যাদের অঞ্চলভিত্তিক ভিত্তি দুর্বল কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য সমর্থন আছে, তারাও একটি গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারে। নারী, সংখ্যালঘু, যুব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বও এ পদ্ধতিতে বাড়ানো সম্ভব, যদি দলগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক তালিকা প্রণয়ন করে।

তবে সমস্যা হলো—বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো কী আদৌ গণতান্ত্রিকভাবে তালিকা প্রণয়ন করবে? নাকি দলীয় প্রধান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল ঠিক করবেন কারা হবেন সংসদ সদস্য? এ প্রশ্নের উত্তর যদি নেতিবাচক হয়, তবে পিআর পদ্ধতি একটি নতুন কায়দার স্বৈরাচার তৈরি করবে। দলগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও পরিবারতন্ত্র, অর্থ-কেন্দ্রিক মনোনয়ন, দলীয় অনুগত্যের ভিত্তিতে পদায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ সংস্কৃতির মধ্যে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ মানেই দলীয় প্রধানের হাতে একটি নিখুঁত মনোনয়ন যন্ত্র তুলে দেয়া। এতে ‘লোক দেখানো অংশগ্রহণ’ হলেও, আসল ক্ষমতা থাকবে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের হাতে।

জনগণের চাহিদা কী?

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চায় সৎ, কর্মঠ, জবাবদিহিমূলক জনপ্রতিনিধি—যিনি জনগণের সেবা করবেন, ভোট পাওয়ার পর নিরুদ্দেশ হবেন না। তারা চায় ভোট দেয়ার পরও জানার অধিকার—আমার ভোট কার বাক্সে গেছে, তিনি কী করবেন, আমি তাকে ধরতে পারব কি না। এখানেই পিআর পদ্ধতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাহিদার একটি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি হয়। যখন কেউ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি গণতন্ত্রে অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে’, তখনই কেউ পাল্টা বলেন, ‘আমার হাত থেকে ভোটের মালিকানা কেড়ে নিচ্ছে এ পদ্ধতি’। এ দোদুল্যমানতা থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন একটি সরল সিদ্ধান্ত নয়।

তবে কি পিআর পদ্ধতিকে ‘না’ বলা উচিত? সম্ভবত না। বরং এ পদ্ধতির কিছু ইতিবাচক দিক গ্রহণ করে একটি মিশ্র পদ্ধতির চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন—সংসদের একটি অংশ অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এবং বাকি অংশ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করা। জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, জাপান—অনেক দেশেই এমন মিশ্র পদ্ধতি কার্যকরভাবে চলছে। তবে এর আগে দরকার রাজনৈতিক সংস্কারের। দলীয় গণতন্ত্র, মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, তালিকা প্রণয়নে জন-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে, পিআর হোক বা সরাসরি নির্বাচন—উভয় ক্ষেত্রেই ভোটার বঞ্চিত থাকবেন। তাই পদ্ধতির চেয়ে জরুরি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ

পিআর হোক বা না হোক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই হলো গণতন্ত্রের মূল শর্ত। সেটি নিশ্চিত করতে হলে, প্রথমেই দরকার ভোটারদের আস্থা ফেরানো। অতীতে একতরফা নির্বাচন, বিনাভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন, দিনের ভোট রাতে, দলবাজি, ভোট ডাকাতি, প্রার্থীর ওপর হামলা—এসবই ভোটারদের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তায় ঠেলে দিয়েছে। এ আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হলে, স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন, প্রার্থীদের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, দলীয় গঠনতন্ত্রে স্বচ্ছতা—এসবই জরুরি। শুধু একটি নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও পথ হাঁটছে—পাকাপোক্ত হয়নি। এ পথে চলার সময় আমাদের দরকার এমন একটি ব্যবস্থাপনা, যেখানে ভোটারের মতামতই শেষ কথা। তাই পিআর পদ্ধতি নিয়ে কথা বলার সময় আমাদের এ সত্যটি মনে রাখতে হবে—গণতন্ত্রের মালিক জনগণ, আর তাদের ভোট যেন তাদেরই হাতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় গণতন্ত্র চর্চা করা। তাহলে পিআর হোক কিংবা সরাসরি ভোট—কোনো ব্যবস্থাই জনগণের বিরুদ্ধে যাবে না।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়