Apan Desh | আপন দেশ

উচ্চ ‍মুনাফাতেও বঞ্চিত বিনিয়োগকারীরা, সিটি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে প্রাতিষ্ঠানিকরা

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:০২, ১৪ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ১৬:৩৮, ১৫ আগস্ট ২০২৫

উচ্চ ‍মুনাফাতেও বঞ্চিত বিনিয়োগকারীরা, সিটি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে প্রাতিষ্ঠানিকরা

ফাইল ছবি

দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে হালসময়ের আলোচনায় দি সিটি ব্যাংক পিএলসি। উচ্চ ‍মুনাফাতেও বঞ্চিত ব্যাংকটির শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা।

অন্যদিকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি বুঝে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

সবশেষ ২০২৪ সালে সিটি ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে তার অংশ জুটেনি। মুনাফা বাড়লেও নগদ লভ্যাংশ কমে যাওয়ায় আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

যার ফলে গত দুই বছর ধরে ব্যাংকটির শেয়ারদর খুব ঘনঘন উঠানামা করছে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যর উপর ভরসা করতে পারছেন না অনেকেই। ভবিষ্যতে আর্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠবে তা আগাম পূর্বাভাস ধরে নিয়ে ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন শেয়ারবাজারের বড় অংশীদার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে গত দুই বছর ধরেই কমছে শেয়ার ধারণের অংশ।

ব্যাংক বড় অঙ্কের মুনাফায় থাকলে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার কেনার প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু সিটি ব্যাংকে তা ব্যতিক্রম হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের শেয়ারের অংশ কমছে দুই বছর ধরেই। পরিচালকরা কি আগাম তথ্য জেনে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, সেই প্রশ্নটি উঠছে। বড় অঙ্কের মুনাফা দেখানোতে সাধারণ বিনিয়োগকারিদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।

গত ২০২৪ সালের হিসাবে হাজার কোটি টাকার মুনাফা দেখানোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ কারণে পতনে থাকা দর গত ছয় মাসে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ সুযোগে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সিটি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

প্রশ্ন উঠেছে, হাজার কোটি টাকার বেশি দেখানো মুনফা কি কৃত্রিম? মুনাফা দেখানোর অর্থ কোথায় আছে।

যা বলছে সিটি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য:

২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছে এক হাজার ২৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এক বছরেই মুনাফা বেড়েছে ৩৮৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বা ৩৮ শতাংশ। গত অর্থাৎ ২০২৩ সালে যা ছিল ৬৩৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

২০২৪ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যাংকটি লভ্যাংশ ঘোষণা করে ২৫ শতাংশ। যার মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস।

২০২৩ সালে বিনিয়োগকারিদের জন্যও ব্যাংকটি লভ্যাংশ ঘোষণা করে ২৫ শতাংশ। যার মধ্যে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ ছিল বোনাস।

সবশেষ বছরে মুনাফার অঙ্ক বাড়লেও নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ কমেছে বিনিয়োগকারিদের। ব্যবসার সর্বস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য নীতি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান বেশি মুনাফা করলে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সমস্যা দেখা দিলেই বোনাস শেয়ারের দিকে ঝুঁকেন উদ্যোক্তারা।

শেয়ার বাজারে ধারাবাহিক বোনাস শেয়ার দেয়া কোম্পানিগুলো এক সময়ে বড় ধরনের আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করলেই বিনিয়োগকারীরা সাবধান হয়ে যান। সিটি ব্যাংক গত ৮ বছর ধরেই বোনাস শেয়ার দিয়ে যাচ্ছে। বোনাস শেয়ারের ধারা থেকে বের হতে পারছে না।

এ কারণে ব্যাংকটির শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণের হার ছিল ২৬.৯৬ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরে এসে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে দাঁড়ায় ২৩.৬৭ শতাংশে। ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই এ হার আরও হ্রাস পেয়ে ২২.৪৯ শতাংশে পৌঁছেছে।

একই সময়ে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ধারণের হারও হ্রাস পেয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে তাদের শেয়ার ধারণের হার ছিল ৩০.৪২ শতাংশ। যা ২০২৫ সালের ৩১ জুলাইয়ে কমে ৩০.৩৬ শতাংশে দাঁড়ায়। বিপরীতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুনে তাদের শেয়ার ধারণের হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। যা ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই এসে বেড়ে ৪০.৫১ শতাংশে পৌঁছে।

শেয়ারদরের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দর দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অস্বাভাবিক উত্থানের পেছনে ২০২৪ সালের ১,০১৪ কোটি টাকা মুনাফার ঘোষণা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ প্রধান ভূমিকা রাখে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ সুযোগে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। যা তাদের আস্থার অভাব নির্দেশ।

আর্থিক পারফরম্যান্সে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সিটি ব্যাংকের ইপিএস (আর্নিংস পার শেয়ার) ছিল ৫.২১ টাকা। এটি ২০২৪ সালে বেড়ে ৭.৫৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে বড় মুনাফা সত্ত্বেও নগদ লভ্যাংশ ১৫ শতাংশ থেকে কমে ১২.৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যবসার সর্বজনীন নীতি অনুযায়ী, মুনাফা বাড়লে নগদ লভ্যাংশ বাড়ার কথা। কিন্তু সিটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটছে। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করছে।

এত লাভের উৎস কোথায়?

করোনা মহামারির সময়ে ব্যাংকটি ব্যয় কমাতে ও মুনাফা ধরে রাখতে কর্মীদের ১৬ শতাংশ বেতন কমিয়েছিল। বন্ধ করে ছিল ইনসেনটিভ বোনাস, উৎসব ভাতা। কর্মীদের বেতনসহ সকল সুবিধা বাতিল করায় ২০২১ সালে মুনাফা করে ৫৪৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা, পরের বছরে ২০২২ সালে মুনাফা করে ৪৭৮ কোটি ১২ লাখ টাকার ও ২০২৩ সালে করে ৬৩৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সবশেষ ২০২৪ সালে হঠাৎ করে এত মুনফা বৃদ্ধি দেখানোর কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি ব্যাংকটি।

আরও পড়ুন<<>> ব্যাংক লুটছেই নোমান গ্রুপ

গত ৫ বছরে ব্যাংকটির মুনাফায় এত বড় লাফ কখনো দেখা দেয়নি। বেশি মুনাফা করলেও ২০২৪ সালে বিনিয়োগকারিদের ডিভিডেন্ড ঈল্ড বা শেয়ার প্রতি বিনিয়োগের বিপরীতে আনুপাতি আয় হয় মাত্র ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অথচ তার আগের বছরে ৬৩৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা মুনাফা করলেও তখন ডিভিডেন্ড ঈল্ড ছিল ৭ শতাংশ। একদিকে শেয়ারের দর স্থির থাকছে না অন্য দিকে বেশি মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারিদের ঈল্ড কমে যাচ্ছে।

সিটি ব্যাংকের বক্তব্য

বিষয়গুলো সম্পর্কে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো- ব্যাংকের ডিভিডেন্ড, অর্জিত মুনাফার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যু করা ‘ব্যাংকের জন্য শেয়ারের বিপরীতে ডিভিডেন্ড ঘোষণার নীতিমালা‘-র উপর নির্ভরশীল। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ডিভিডেন্ড ঘোষণার বেলায় ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাতকে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নীতিমালা অনুযায়ী ২০২৪ সালে ব্যাংকের জন্য উল্লিখিত সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ড ৩৫.০% (১৭.৫% নগদ ও ১৭.৫% বোনাস) ঘোষণা ও বিতরণের সক্ষমতা সিটি ব্যাংকের ছিলো। 

আরও পড়ুন<<>> সিটি ব্যাংক এমডি মুজিববাদী মাসরুর আরেফিন এখন ব্যাংকখাতের ভয়

তা সত্ত্বেও ২০২৪ সালে সম্মানিত শেয়ারহোল্ডারগণের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ডিভিডেন্ডের হার (২৫.০%) ঘোষণা করার অন্যতম কারণ ছিলো—ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মুনাফার প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা ও ভবিষ্যতে সম্মানিত শেয়ারহোল্ডারগনকে আরো বেশি নিয়মিত ডিভিডেন্ড ঘোষণা এবং বিতরণ করার লক্ষ্যে ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তি মজবুত করা। 

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ডিভিডেন্ডের পরিমাণ বিবেচনায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের জন্য সম্মানিত শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে ৩১ কোটি টাকা বেশি বিতরণ করা হয়েছে। 

সিটি ব্যাংকের মুনাফার উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি ও লভ্যাংশ ঘোষণায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখায় ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের ভরসা বেড়েছে, যার প্রতিফলন ঘটে শেয়ার ধারনের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর হার বৃদ্ধিতে।

২০২৪ সালের শেষে সিটি ব্যাংকের শেয়ারে সাধারণ জনগণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর ধারণের হার ছিলো যথাক্রমে ৩৯.৭৬% ও ৫.৭২%, যা ২০২৩ সালের শেষে ছিল ৩৬.৯১% ও ৪.৮৭%।

আরও উল্লেখ করা যায় যে, তারল্য ব্যবস্থাপনায় সিটি ব্যাংক সবসময় দক্ষতার পরিচয় রেখেছে, যা ২০২৪ সালে সরকারের অনুরোধে অপেক্ষাকৃত কিছু দুর্বল ব্যাংককে ১,৬৬০ কোটি টাকা নগদ তহবিল দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।

আরও পড়ুন<<>> র‌্যাংগসের পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা, দুদক ম্যানেজ তিন কোটিতে

সিটি ব্যাংকের এমডির কথায় প্রমাণ মেলে ব্যাংকের মুলধন পর্যাপ্ততা নিয়ে। সক্ষমতা না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক সাড়ে ১৭ শতাংশের বেশি নগদ মুনাফা দিতে নিষেধ করে। মুলধন পর্যাপ্ততা না থাকায় কাগজে আয় বাড়লেও বোনাস লভ্যাংশ দিতে হয় ব্যাংকটিকে। এজন্য বিনিয়োগকারিদের ডিভিডেন্ডও কমছে বছরের পর বছর। এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারি কেনো শেয়ার ছাড়ছে ও শেয়ার দরে এত উঠানামা আস্থাহীনতা কি না তারও কোনো উত্তর দেননি এমডি।

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়