Apan Desh | আপন দেশ

র‌্যাংগসের পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা, দুদক ম্যানেজ তিন কোটিতে

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ১ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১০:৪৫, ২ জুলাই ২০২৫

র‌্যাংগসের পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা, দুদক ম্যানেজ তিন কোটিতে

জে. ইকরাম হুসেন, সচিমি হুসেন ও বিনাশ হুসেন। ছবি: সংগৃহীত

আগে ছিল ‘সনি র‌্যাঙগস’ নামে পরিচিত। হালের পরিচিতি ‘র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিক্স লি.। আত্মসাৎ করেছে সরকারের অন্তত: ৪ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন আইসিটি প্রকল্পে ইলেকট্রনিক পণ্য ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের নামে লুটেছে শত শত কোটি টাকা। মাফিয়া শাসনামলে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ র‌্যাংগস গ্রুপের বিরুদ্ধে। 

জাল-জালিয়াতি, ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকিসহ বহুমাত্রিক আর্থিক অপরাধ করেও ‘র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিক্স’ ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, জাতীয় রাজস্ববোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠান মালিকগণ অপ্রতিরোদ্ধ গতিতে অপরাধগুলো করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রমাণ থাকার পরও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো  দেখার ভান করেছে। 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ সাড়ে ১০হাজার কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাতের অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়েছেন দুদকের একজন মহাপরিচালক ও সাবেক একজন কমিশনারসহ আরও কয়েকজন।   

মালিকদের তুঘলকি অস্ত্র দ্বৈত নাগরিকত্ব!

র‌্যাংগস ইলেকট্রনিকস লিমিটেড। এখন ‘সনি র‌্যাঙগস’ নামে সমধিক পরিচিত। ৪১ বছর আগে ১৯৮৪ সালে মরহুম আখতার হুসেন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুর পর স্ত্রী-সন্তানরা এখন প্রতিষ্ঠানটির মালিক। ‘র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকতার হুসাইনের পুত্র জে. একরাম হুসাইন। ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন তার ভাই বিনাস হুসাইন। ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে আছেন আকতার হুসাইনের স্ত্রী সাচিমি হুসাইন।
মালিকদের জাপানি নাগরিকত্ব আছে। যখনই বাংলাদেশের কোনো আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের অপরাধ তদন্তে নামে-তখনই তারা সামনে আনেন ‘জাপানি নাগরিকত্ব’। উল্লেখ করা হয়-তাদের ব্যবসায় জাপানি বিনিয়োগ রয়েছে। মামলা- মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করলে জাপানিরা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবে, হাজার মানুষ বেকার হবে। ফলে তদন্তকারী সংস্থাগুলো সুবিধার বিনিময়ে হাস্যকর যুক্তির ভিত্তিতে সাধু’ উপাধি দিয়েছে। তাদের নির্দোষ বলে আখ্যা দেয়।
নথিপত্র মতে, প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান আকতার হুসেনের স্ত্রী সাচিমি হুসেন জন্মসূত্রে জাপানের নাগরিক। জাপানে তিনি ‘সাচিমি ওগাওয়ারা’ নামে পরিচিত। মা জাপানি নাগরিক হওয়ার সুবাদে তার দুই ছেলে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জে. একরাম হুসাইন এবং ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিনাস হুসাইন দু’জনেরই জাপানি নাগরিকত্ব রয়েছে। জে.একরাম হুসাইন জাপানে ব্যবহার করেন ‘টোমোয়িকো ওগাওয়ারা’ নাম। বিনাস হুসাইন জাপানে ‘মিকো ওগাওয়ারা’ নাম ব্যবহার করেন। তারা তিন জনই জাপানের পাসপোর্টধারী দ্বৈত নাগরিক। জাপানি নাগরিক হিসেবে তারা সিঙ্গাপুরে বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন। সেখানে ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। বিপুল অর্থ লেনদেন করছেন। অর্থ পাচার করেছেন জাপানেও। সেখানে বিপুল সম্পত্তিও কিনেছেন।

পাচার ও কর ফাঁকির কিঞ্চিৎ নমুনা

র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকস লি: বর্তমানে রাজধানীর সোনারগাঁও রোডের ১২, সোনারতরী টাওয়ার, ৪ ও ৫ লেভেলকে করপোরেট অফিস হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রতিষ্ঠানটি ৪১ বছর ধরে বছরে গড়ে দেশে ৭শ’ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রি বিক্রি করেছে। এ হিসেবে এ যাবৎ অন্তত: ২৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রি বিক্রি করে। যার আমদানি মূল্য ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ প্রতিষ্ঠানটি খুচরা বিক্রির ওপর ভ্যাট এবং ফ্যাক্টরি ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর বিবরণীতে অনেক কম বেচা-বিক্রি প্রদর্শন করে। আয়কর ফাঁকি দেয়ার জন্য ৭০ শতাংশ কম মূল্য দেখিয়ে এলসি খুলে ৩০ শতাংশ হারে টাকা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ পাঠাচ্ছে। বাকী ৭০ ভাগ টাকাই (অঙ্কের হিসেবে ১০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা) অবৈধভাবে ইউএস ডলার কিংবা দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে অবস্থিত র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকস’রই নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাস্ট মোটো প্রাইভেট লিমিটেডে পাঠাচ্ছে।  

রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালি ব্যাংকের বাংলা মোটর শাখা ম্যানেজার, জনতা ব্যাংকের তৎকালিন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আব্দুস সালাম আজাদকে ১০ শতাংশ হারে কমিশন দিয়ে এ অর্থ পাচার করা হয়। এনবিআর’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতিবছর ঘুষ দিয়ে এটি রফা-দফা করছে। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার এনায়েত মল্লিক এনবিআর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে এসব ‘ম্যানেজ’ করছেন।

সিঙ্গাপুরের ঠিকানা

(GK) Kitchener Link,City Square Residences,Unite-24-05,Singapore-207227 (`yB) Trust motto pvt Ltd, 140,Paya Lebar Road # 10-22,AZ@PAYA Laber Singapore,409015 Singapore ব্যবহৃত এসব সম্পত্তির মালিক মরহুম আকতার হুসেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বর্তমান সাচিমি হুসাইন, জে. একরাম হুসাইন ও বিনাস হুসাইন। আকতার হুসেইন ইন্তেকালের পর তার স্ত্রী,পুত্র এবং তাদের স্ত্রী বিদেশী নাগরিক হওয়ায় এদেশে থাকা সম্পত্তিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন। বিক্রয়লব্ধ টাকা কখনো হুন্ডি, কখনো আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে সরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশে। আওয়ামী আনুগত্য ও দলীয় শেল্টারে ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটি আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বছরে গড়ে সাড়ে ৭ শ’ কোটি টাকা হিসেবে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার করে। সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংকে কোন তারিখে কোন পণ্যের কত টাকা পাচার করা হয়েছে এর বিশদ প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকসের ভয়ঙ্কর প্রতারণা

আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ডিউটি ফ্রি শপ খুলে খোলাবাজারে মদ সরবরাহ, ভুয়া বার্ষিক অ্যাকাউন্টস ট্যাক্স সার্কেলে জমা দিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি, নকল পণ্য সরবরাহ করছে। 

প্রতিষ্ঠানটি বিদেশী ব্র্যান্ডের কেলভিনেটর ফ্রিজ,এসি,ওয়াল্টনের কারখানায় তৈরি করে সেসব ‘মালয়েশিয়া তৈরি’ মর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারণালব্ধ শত শত কোটি টাকা আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুরে ‘ট্রাস্ট মোট্টো প্রা:লি:’ নামক নিজেদেরই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে রাখছে। টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার মিথ্যা তথ্য প্রচার করে নকল পণ্য বিক্রি করছে। ক্রেতাদের প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছে।

২০২১ সালে র‌্যাংগস ইলেকট্রনিকস’র প্রতারণা কারণে প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা ঢাকা (সি.আর মামলা নং-৭১৮/২১), কুমিল্লা, নোয়াখালির মাইজদিসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু প্রতারণার মামলা করেছেন। ঢাকার মামলাটি তদন্ত শেষে পিবিআই চার্জশিটও দাখিল করেছে। তবে মোটা অংকের টাকা খরচ করে সেগুলোর বিচার, তদন্ত এবং অনুসন্ধান ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে বিপুল অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে নিয়েছেন দায়মুক্তি।

আরও পড়ুন<<>> বেনামি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মোরশেদ আলমের শত শত কোটি টাকা পাচার

অনুসন্ধানে জানা যায়, নামে-বেনামে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য ও যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে জে.একরাম হুসাইন, বিনাস হুসাইন, তাদের মা সাচিমি হুসাইন, তাদের স্ত্রী-সন্তান এবং তাদের ঘনিষ্ট জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) জানে আলম, এনায়েত মল্লিক, ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) নজরুল আমিনকে দেয়া হয়েছে দায়মুক্তি। এর মধ্যে দুদক থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয় কোনো ধরণের অনুসন্ধান ছাড়াই।

২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি সংস্থার তৎকালিন দুদক পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল এ দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.৫৬৮.২০২৩.২৫১১) দেন। দুদকের তফসিলভুক্ত (অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার) এ অভিযোগের কোনো অনুসন্ধান না করে কৌশলে পাঠিয়ে দেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। অথচ কোনো ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান-তদন্ত করার আইনি এখতিয়ার পুলিশের নেই। তাছাড়া র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকসের ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে আন্ডার ইনভয়েস করেছে-এ প্রক্রিয়ায় এনবিআর এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা জড়িত। ফলে র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকসের অর্থপাচার অভিযোগের অনুসন্ধান-তদন্ত করার এখতিয়ারও দুদকের।

শুধুমাত্র দুদকেরই এ ধরণের অনুসন্ধান-তদন্তের আইনি এখতিয়ার রাখে। এ ধরণের অভিযোগগুলো দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬ (২), ২৭ (১) এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২), ৪(৩) ধারাসহ একাধিক ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তযোগ্য। কিন্তু তৎকালিন কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে উত্তম কুমার মন্ডল কয়েক কোটি টাকার নজরানার বিনিময়ে অনুসন্ধান-তদন্তের সুপারিশ না করে কৌশলে দিয়েছেন দায়মুক্তি। অভিযোগটি পাঠিয়ে দেন অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান-তদন্তের এখতিয়ার বহির্ভুত প্রতিষ্ঠান সিআইডিতে।

অন্যদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বিষয়টিকে নিজেদের ‘এখতিয়ার বহির্ভুত’ গণ্য করে দ্রুততার সঙ্গে র‌্যাঙগস মালিকদের অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়। এ অপকর্ম করেছেন সিআইডি’র ইন্সপেক্টর মো: মনিরুজ্জামান। লুটেরাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট না দিয়ে তদন্তটি নথিভুক্ত করেছেন। নিজেদের তফসিলভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দুদক কিভাবে অভিযোগটি সিআইডিতে পাঠিয়েছে-জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো: আকতার হোসেন আপন দেশকে বলেন, এটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। বিগত কমিশন কোন্ বিবেচনায় এটি সিআইডিতে পাঠিয়েছে বোধগম্য নয়। ব্যবস্থার প্রক্রিয়াটাই সঠিক হয়নি।

নামে- বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচাররের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হয় ‘র‌্যাঙগস ইলেকট্রনিকস লি:’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক জে.একরামের সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, সায়মন নামের জনৈক ব্যক্তি আপনার প্রশ্ন জনাব জে.একরাম হুসাইন স্যারকে পৌঁছাবো। তিনি জবাব দিলে জানাবো। 

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়