Apan Desh | আপন দেশ

ব্লু প্রিন্টে নেতৃত্বশূন্য ইসলামী ব্যাংক, বোর্ড মিটিং স্থগিত

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১১:৩০, ২০ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১২:১০, ২০ জুলাই ২০২৫

ব্লু প্রিন্টে নেতৃত্বশূন্য ইসলামী ব্যাংক, বোর্ড মিটিং স্থগিত

ছবি সংগৃহীত

ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এখন নেতৃত্বশূন্য, নীতিহীন এবং আস্থাহীনতার গভীর সংকটে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ, পুরনো শরিয়াভিত্তিক এ বেসরকারি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যান পদ এখন শূন্য।

সম্প্রতি এমডি মনিরুল মাওলাকে দুর্নীতির অভিযোগে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। পরে তিনি গ্রেফতার হন। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ পদত্যাগ করেন অর্থনৈতিক লেনদেন ও অনিয়মের অভিযোগে। নতুন কাউকে এখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে ব্যাংকটি কার্যত নেতৃত্বহীন।

এ শূন্যতা নিছক দুর্ঘটনা নয়—একটি পরিকল্পিত চক্রান্তের ফল বলে মনে করছেন অনেকেই। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন, একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংককে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আর তাদের এ ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার সিদ্ধান্ত ও ভূমিকাকে ঘিরে আজ প্রশ্নের শেষ নেই।

নেতৃত্বহীনতার মধ্যে সংকট আরও ঘনীভূত

বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে আছেন কেবল একজন ভারপ্রাপ্ত এমডি—ওমর ফারুক খান। তবে স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকের কার্যক্রমে নীতিনির্ধারণে স্থবিরতা স্পষ্ট। বিভিন্ন প্রকল্প, ঋণ অনুমোদন, কর্মী পদোন্নতি ও গ্রাহকসেবা—সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা প্রকট।

এরই মধ্যে রোববার (২০ জুলাই) অনুষ্ঠিতব্য পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক (বোর্ড মিটিং) কৌশলগত কারণে স্থগিত করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বোর্ড মিটিং ঘিরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি ‘অঘোষিত বার্তা’ ছিল—বামপন্থী মনোভাবাপন্ন একজন স্বতন্ত্র পরিচালককে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার। তবে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী এতে আপত্তি জানায়। ফলে ওই পরিচালককে ঠেকাতেই বোর্ড মিটিং “অনিবার্য কারণে” বাতিল করা হয়।

এস আলম গ্রুপের দখল-ধ্বংসের ভিত্তি

গত এক দশকে ইসলামী ব্যাংকের উপর একক প্রভাব বিস্তার করে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। আওয়ামী লীগ সরকারের নীরব প্রশ্রয়ে তারা পরিচালনা পর্ষদ, ঋণ বিতরণ, নিয়োগ এমনকি আভ্যন্তরীণ নীতিমালাও নিজেদের মতো সাজিয়ে নেয়। তদন্ত সংস্থাগুলোর মতে, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নেয়। যার বড় অংশ এখনো অনাদায়ী।

আরও পড়ুন<<>>এবার বিএফআইইউ ধরেছে চেয়ারম্যানকে

এস আলম গ্রুপের দখলে থাকার সময় ব্যাংকটিতে একের পর এক অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং গোপন চুক্তির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটে। ব্যাংকটির আইটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সিঁদকাটার ভূমিকায় ছিল। এমনকি ব্যাংক খাতে লুটপাটের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ইসলামী ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরব সহযোগিতা?

ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল ইসলামী ব্যাংকের অনিয়ম ঠেকানো ও আস্থা ফিরিয়ে আনা। অথচ তারা শুধু নীরব থেকেছে নয়, একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনে কোটি কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে, অথচ তারা চুপ থেকেছে কেন?’ তাদের দাবি, পরিকল্পিতভাবেই এ অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে যাতে গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয় এবং অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংক লাভবান হয়।

রেমিট্যান্স হারানোর ধাক্কা

ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের পছন্দের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু চলমান অনিশ্চয়তা, অনিয়ম এবং ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় সে আস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। প্রবাসীরা বিকল্প ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন। যার ফলে ইসলামী ব্যাংক হারাচ্ছে এক গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস।

পরিকল্পিত ধ্বংস নাকি নীতিগত ব্যর্থতা?

সবশেষে প্রশ্ন উঠছে—ইসলামী ব্যাংক আজ যে অবস্থায় পৌঁছেছে তা কি শুধুই দুর্নীতি আর অনিয়মের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো সুপরিকল্পিত ব্লু প্রিন্ট?

ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তা বলছেন, ‘যেভাবে বারবার নেতৃত্বে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে, বোর্ড মিটিং ভেঙে দেয়া হচ্ছে। চেয়ারম্যান নিয়োগ আটকে দেয়া হচ্ছে। তাতে স্পষ্ট এটি একটি চক্রান্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে, কিন্তু তারা করছে না। উল্টো নিয়ন্ত্রক ব্যাংকের শীর্ষ কর্তা শরিয়াভিত্তিক এ ব্যাংকের চালকের আসনে বসাতে চাইছেন তারই বন্ধু জনৈক ইসলামবিদ্বেষীর হাতে।

আরও পড়ুন<<>> র‌্যাংগসের পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা, দুদক ম্যানেজ তিন কোটিতে

এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দেশের গোটা ব্যাংক খাতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখলদারিত্ব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষপাতিত্ব মিলে যেখানে একটি সফল ব্যাংককে ধ্বংস করা যায়, সেখানে আর্থিক নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এক মরীচিকা ছাড়া কিছু নয়।

আপন দেশ /এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়