Apan Desh | আপন দেশ

সিটি ব্যাংকে মুজিববাদী মাসরুর আরেফিন: আর কতো কাল?

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৭ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ০০:৪৫, ৭ আগস্ট ২০২৫

সিটি ব্যাংকে মুজিববাদী মাসরুর আরেফিন: আর কতো কাল?

শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা ‘আগস্ট আবছায়া’র প্রচ্ছদ ও লেখক, সিটি ব্যাংক এমডি মাসরুর আরেফিন। ছবি: সংগৃহীত

চরম অস্থিরতা ও আস্থাহীনতায় কাটানো দেশের ব্যাংক খাতে চলছে সংস্কার। দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টমুক্ত করার চলমান পদক্ষেপে অনেক এমডি বাদ পড়লেও বহাল তবিয়তে আছেন মাসরুর আরেফিন। যিনি সিটি ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

ব্যাংকিং মহলে তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভয়, দ্বিধা ও রাজনৈতিক প্রভাবের গভীর ছায়া। মুজিববাদী পরিচয়ে মাফিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গড়ে তুলেছেন একক আধিপত্য, যা ব্যাংকটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

দলীয় আনুগত্যে ব্যাংকে উত্থান

বরিশালে জন্ম নেয়া, খুলনায় বড় হওয়া আর কলকাতায় লেখা পড়া করা মাসরুর আরেফিনের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু ১৯৯৫ সালে। কয়েক প্রতিষ্ঠানে কাজ করবার পর ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকে যোগদান করেন। এরপর থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসেন শীর্ষ পদে। ২০১৯ সালে তিনি হন সিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও। এ পদে আসার পেছনে পেশাগত যোগ্যতার বাইরে আওয়ামী রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল বড় ভিত্তি। ছাত্রজীবনে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থানকালে থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, যা ব্যাংক পরিচালনার সময় আরও প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।

উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ দিয়ে রাজনৈতিক উত্থ্যান:

রাজনীতির প্রতি আনুগত্য কেবল ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাকে রূপ দেয় শিল্পসাহিত্যে। ‘আগস্ট আবছায়া’ নামে লেখা উপন্যাসে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে রূপক আকারে তুলে ধরেন মাসরুর আরেফিন। তার লেখা তৎকালের জাতীয় শোক দিবসে একটি দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্রে শীর্ষস্থানে ছাপা হয়। নজর কারেন মাফিয়া ডন শেখ হাসিনাসহ দলটির নীতিনির্ধারকদের।

২০১৮ সালে ডিএমডি থাকাকালেই তিনি উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’লেখেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নিহতের ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসটি মূলত ২০১৫ সাল থেকে তার মাথায় আসে।

আরও পড়ুন<<>> এবি ব্যাংকের বিষফোড়া আ.লীগ নেতা তারিক আফজাল!

এমডি হতে ওই উপন্যাসকে হাতিয়ার বানান তিনি। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বইটি লেখেন যখন, এমডি নিয়োগ নিয়ে সিটি ব্যাংকে আলোচনা চলে।

জাতীয় বই মেলা ফেব্রুয়ারি মাসে হলেও তার আগেই বইটি ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হিসেবে নিজেকে জাহির করেন। এতে তার এমডি হওয়ার পথ সুগম হয়।

১) প্রথমা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘আগস্ট আবছায়’ ২) শোক দিবসে পত্রিকায় মাসরুর আরেফিনের লেখা শীর্ষ সংবাদ, ৩) শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহবায়ক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর (কামাল চৌধুরী) ব্যবসায়িক পার্টনার সাহিদুল ইসলাম বিজুর সঙ্গে মাসরুর আরেফিন।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি সিটি ব্যাংকের এসডি হিসেবে নিয়োগ পান ‘আগস্ট আবছায়া’ লেখার সুবাদে। সেই পথচলা এখনো রয়েছে ব্যাংকটিতে। পরবর্তীতে দুর্নীতিবাজ কাজী নাবিলের জেমকন গ্রুপের সাহিত্য পুরস্কার (২০২০), সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক আইএফআইসি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯), ও ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বাগিয়ে নেন তিনি।

এ সাহিত্যকর্মের পরই ব্যাংকপাড়ায় তাকে ঘিরে তৈরি হয় এক ধরনের ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাবমূর্তি। তিন মেয়াদে সিটি ব্যাংকের এমডি পদে পুনর্নিয়োগ পাওয়া ও ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিবি) চেয়ারম্যান হওয়া—সবকিছু মিলিয়ে তার প্রভাব হয়ে পড়ে সর্বগ্রাসী।

সিটি ব্যাংকে ‘দলীয় দুর্গ’ গঠন

সিটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে গত দেড় দশকে প্রায় একচেটিয়াভাবে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই জায়গা পেয়েছেন। ব্যাংকটির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিশাল অঙ্কের ঋণ সুবিধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুদান ও অনিয়মিত লেনদেনের বিষয়েও মাসরুর আরেফিনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

গত ২৭ জুলাই আজিজ আল কায়সার টিটুকে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান, আনোয়ার গ্রুপের হোসেন খালেদকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে পরিচালনা বোর্ড। 

ব্যাংকিং খাতে ভয়ের সংস্কৃতি

সিটি ব্যাংকের নেতৃত্বে মাসরুর আরেফিন থাকায় কর্মকর্তা ও নির্বাহীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ চ্যালেঞ্জ জানাতে সাহস পান না। তার উপস্থিতি ব্যাংকখাতে ‘সিন্ডিকেট সংস্কৃতি’র প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে একজন ব্যক্তির হাতে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যখন একটি ব্যাংকের এমডি দলীয় ছায়ায় থেকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন, তখন পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তথ্য ফাঁস ও নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা

দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারনী কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা শুধু পরিচাললনকারীরাই জানেন। এটা অতি গোপনীয়। দলীয় দোসর হিসেবে যদি তিনি তা প্রচার-প্রকাশ করেন তাহলে দেশের জন্য হবে ভয়ঙ্কর। সমস্যায় পড়বে দেশের ব্যাংকিংখাত।

সাহিত্য পুরস্কার নিচ্ছেন মাসরুর আরেফিন। ‘আগস্ট আবছায়া’র অংশ বিশেষ মাসরুর আরেফিনের ফেসবুকে। ‘আগস্ট আবছায়া’র ইংরেজি অনুবাদক ভারতের অরুণাভ সিনহার লেখা।  ছবি: সংগৃহীত।

যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্ক আরোপ নিয়ে আলোচনার চলাকালে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনর অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় চিঠি প্রকাশ করে দেয়। এরফলে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে ওয়াশিংটনে প্রচুর প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয়। টিম সদস্যরা জানান, ওই চিঠি এনবিআরের কর্মকর্তা ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ফাঁস করে দিয়েছেন। ব্যাংকিংখাতের বা সিটি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট এমন কিছু তথ্য প্রকাশ বা ফাঁস হয়ে গেলে পুরো ব্যাংকিংখাতই বড় ধরনের বিপদে পড়বে।

আরও পড়ুন<<>> এবার জলিলে ডুবছে ইসলামী ব্যাংক!

সিটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিভাগ—বিশেষ করে আইটি ও পরিচালন বিভাগে—যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কিংবা তথ্য গোপনে ফাঁস হয়, তা নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার মতো পরিকল্পিত আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যেমনটি প্রশিক্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে দেশের বিশেষ একটি বাহিনীতেও।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট

সিটি ব্যাংকের আইটিসহ অন্য কোনো বিভাগে ইচ্ছাকৃত বা পরিকল্পিতভাবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার মতো আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিশাল সংখ্যক বিনিয়োগকারী ব্যাংকটির নেতৃতত্বের প্রতি আস্থা রাখবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যাংকটিতে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আমানতকারীদের কী হবে সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। ব্যাংকখ্যাত স্পর্শকাতর হওয়ায় আওয়ামী পেতাত্মার হাতে সিটি ব্যাংক নিরাপদ নয়-এমন দাবি ব্যাংকটির কর্মকর্তাদেরও।

সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দু

সিটি ব্যাংক এখন আর কেবল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি পতিত আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক পরিপূরক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মাসরুর আরেফিন এ রাজনৈতিক-ব্যাংকিং মেলবন্ধনের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সব জায়গায় প্রভাব বিস্তার করছে।

শুধু ব্যাংকার্সই নন; সিটি ব্যাংকসূত্র বলছে, গত দেড়যুগে ব্যাংকটির পরিচালনা বোর্ডে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছাড়া কোনো ব্যক্তিইর জায়গা হয়নি। দলীয় নেতাদের সমন্বয়ে গড়া সিটি ব্যাংক পরিচালনা বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একচেটিয়া। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় অঙ্কের ঋণসুবিধা প্রদান থেকে শুরু করে দলের ডোনার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছেন এ সিটি ব্যাংককে।

আরও পড়ুন <<>> ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন বামপন্থী জুবায়দুর

নানান ইস্যুতে দিয়েছেন ডোনেশন। ব্যাংকটি সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বড় ধরনের বরাদ্দ ছাড়াও কোটি কোটি টাকা নেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের আমানত থেকে। এসব নিয়ে কোনো বাক্য প্রয়োগের মতো পরিবেশ রাখেনি ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ছিল নিষ্ক্রিয়।

মাসরুর আরেফিন ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যাংকার হলেও তার অবস্থান এখন রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক। এ মেলবন্ধন দেশের ব্যাংকিং খাতের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা টলমল করছে এবং তৈরি হয়েছে এক অনিরাপদ পরিস্থিতি। মুজিববাদী পরিচয়ে গড়ে ওঠা এ একচ্ছত্র আধিপত্য—আজ গোটা ব্যাংকিং খাতের জন্য এক গভীর ভয় ও সংকটের নাম।

বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে সিটি ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান হোসেন খালেদকে ০১৭১১ *** ৯৬৮ নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা দিয়ে মন্তব্য নেয়ার চেষ্টাতেও সাড়া দেননি হোসেন খালেদ।    

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়