Apan Desh | আপন দেশ

পাউবোর শুভ্র যেনো সেই ‘আবেদ আলীর’ শিষ্য, অবৈধ সম্পদেও সেরা

বিশেষ প্রতিবেদক, আপন দেশ

প্রকাশিত: ১৯:১৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৯:৪৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

পাউবোর শুভ্র যেনো সেই ‘আবেদ আলীর’ শিষ্য, অবৈধ সম্পদেও সেরা

শুভ্র আহমেদ

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মতো একটি কৌশলগত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যদি প্রশ্নফাঁসই হয়ে ওঠে নিয়োগের নিয়তি, তবে সেটি কেবল দুর্নীতি নয়- রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। পাউবোর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ্র আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেই সামনে এনেছে।

গত নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর দায়ের করা লিখিত অভিযোগে প্রশ্নফাঁস, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার সিন্ডিকেট, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। অভিযোগকারীদের ভাষায়, পাউবোর এ কর্মকর্তা যেন আলোচিত বিসিএস প্রশ্নফাঁসের হোতা ড্রাইভার আবেদ আলীরই পথ অনুসরণকারী এক নতুন নাম।

প্রশ্নফাঁস: নিয়োগ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভাঙার অভিযোগ
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শুভ্র আহমেদ ২০১৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পাউবোতে যোগ দেন। কিন্তু ২০১৯ সালেই তিনি মানব সম্পদ পরিদফতরের নিয়োগ শাখায় এমন এক সংবেদনশীল দায়িত্বে যুক্ত হন, যেখান থেকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, টাইপিং ও প্রিন্টিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ তৈরি হয়।

আরও পড়ুন<<>> ন্যাশনাল লাইফের তদন্তে দুদক: ২১শ’ অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন, ৭১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ-পাচার

২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাউবোর নিয়োগ পরীক্ষাগুলো অভ্যন্তরীণভাবে পরিচালিত হতো। অভিযোগ অনুযায়ী, এ সময়টিতে প্রশ্নপত্র টাইপিং ও প্রিন্টিংয়ের দায়িত্বে থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষার আগেই অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়েছে। একাধিক পরীক্ষার্থী ও দালালচক্রের মাধ্যমে এ প্রশ্নফাঁস পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
প্রশ্নফাঁস কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়। এটি মেধাকে হত্যা করে, যোগ্যতাকে নির্বাসনে পাঠায়। একজন সরকারি প্রকৌশলীর হাতে প্রশ্নপত্র নিরাপদ না থাকলে সে প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় দাঁড়ায়- এ প্রশ্নই এখন উঠছে।

নিয়োগ শাখা: ব্যক্তিগত আয়ের যন্ত্র?
অভিযোগকারীদের দাবি, নিয়োগ শাখা শুভ্র আহমেদের কাছে কার্যত একটি অবাধ অর্থ উপার্জনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। চাকরি পেতে যোগ্যতার বদলে দরকার ছিল টাকা ও যোগাযোগ। এর ফলে বহু যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় নিয়োগ ব্যবস্থার ওপর তরুণদের আস্থা ভেঙে পড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটেই অভিযোগকারীরা পাউবোর শুভ্রকে আবেদ আলীর সঙ্গে তুলনা করছেন। কৌশল ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক- নিয়োগ ব্যবস্থাকে লুটপাটের যন্ত্রে পরিণত করা।

পদোন্নতি ও নারায়ণগঞ্জে দুর্নীতির বিস্তার
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এমন অভিযোগের মধ্যেই শুভ্র আহমেদ পদোন্নতি পান। অভিযোগ রয়েছে, মেধাক্রম উপেক্ষা করে বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে উন্নীত হন- যা পাউবোর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে দাবি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন<<>> সিটি ব্যাংক এমডি মুজিববাদী মাসরুর আরেফিন এখন ব্যাংকখাতের ভয়

এরপরই তাকে নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি টেন্ডার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পরিচালন খাতের টেন্ডার নিজের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের পাইয়ে দেয়া হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে বরাদ্দ অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগ উঠেছে।
বাস্তবতা কী বলছে? শুষ্ক মৌসুমেও নারায়ণগঞ্জের বহু এলাকায় জলাবদ্ধতা কমেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ হয়েছে কাগজে-কলমে। মাঠপর্যায়ে তার কোনো দৃশ্যমান ফল নেই।

দফতর পরিচালনায় অনিয়ম
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনে তিনি চরমভাবে উদাসীন। এলাকাবাসী জানায়, অফিসে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই তাকে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগত কাজে নিয়মিত অফিসের বাইরে থাকেন। সরকারি গাড়ি অফিস সময়ের পর ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। এতে জ্বালানি ব্যয়সহ সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদ
দুদকে দেয়া অভিযোগে শুভ্র আহমেদের সম্পদের একটি বিস্তৃত তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২২ সালে নিজ জেলা নওগাঁয় তিনি একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জে রয়েছে ১৮০০ বর্গফুটের একটি প্লট।

আরও পড়ুন<<>> বেনামি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মোরশেদ আলমের শত শত কোটি টাকা পাচার

এছাড়া ঢাকা ও গাজীপুরে তার নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট ও জমি, খামার এবং একটি রিসোর্টে শেয়ার থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের কথাও অভিযোগে উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে- একজন সরকারি প্রকৌশলীর বৈধ আয়ে এ সম্পদ কীভাবে সম্ভব?

পতিত আ.লীগের ছত্রছায়া: সাহসের উৎস
অভিযোগে বলা হয়েছে, শুভ্র আহমেদ নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকার আমলের পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিতেন। এ পরিচয়ই ছিল তার সবচেয়ে বড় ঢাল। এ প্রভাবের কারণে দীর্ঘদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন।

রাজনৈতিক পরিচয় যদি দুর্নীতির লাইসেন্স হয়ে যায়, তবে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি কোথায় দাঁড়ায়- এ প্রশ্ন এখন অনিবার্য। এ অভিযোগ যদি সত্যের কাছাকাছিও হয়, তবে প্রশ্ন শুধু একজন কর্মকর্তাকে ঘিরে নয়। কীভাবে একজন কর্মকর্তা সাত বছর ধরে একই নিয়োগ শাখায় থাকেন? পদোন্নতির সময় যাচাই কোথায় ছিল? টেন্ডার ও সম্পদের বিষয়গুলো এতদিন নজরের বাইরে থাকল কীভাবে?

দুদকের জন্য এটি কেবল একটি অভিযোগ নয়- এটি রাষ্ট্রীয় নিয়োগ ব্যবস্থার আস্থার প্রশ্ন। দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃশ্যমান তদন্ত ছাড়া এ আস্থা ফিরবে না। পাউবোর শুভ্র যদি সত্যিই আবেদ আলীর পথেই হাঁটেন, তবে থামাতে হবে এখনই। নইলে বার্তা যাবে ভয়ংকর- ক্ষমতা থাকলে প্রশ্নফাঁস করেও পার পাওয়া যায়। জনস্বার্থে এ অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।

প্রকৌশলী শুভ্রর বক্তব্য-
এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে শুভ্র আহমেদ অভিযোগগুলোর বিষয়ে অবগত হন। তিনি বলেন, আমি প্রশ্নপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, ওসব উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দেখে থাকেন। আওয়ামী লীগ শাসন আমলের সাবেক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

সম্পদের বিবরণ শুনার পর তিনি বলেন, শুনতে ভালো লাগছে, এসব আমার থাকলে খুশি হতাম। অভিযোগগুলো আমাকে হেয় করার জন্য দাখিল করা হয়েছে, আমি ডেস্কে জব করে আসছি এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।  

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

Advertisement

জনপ্রিয়