
বিএনপি লোগো
জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিদিনই নতুন মোড় নিচ্ছে। একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ডান-বামে মিশেল মধ্যপন্থী দল বিএনপির সামনে নানা রাজনৈতিক বেরিকেড তৈরি হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, তারা শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি চাপে নন, বরং একসময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতের সক্রিয়তাও তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে শিক্ষাঙ্গন ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে বিএনপির অভিযোগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে সরাসরি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব না পড়লেও জামায়াত শিবিরের মধ্যে দেখা দিয়েছে একধরনের উচ্ছ্বাস। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সংগঠনের প্রভাব দেখিয়ে তারা আবারও রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলানোর চেষ্টায় তরুণদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। বলছে, লেখাপড়া শেষ করামাত্রই চাকরি দেয়া হবে, দাবি নিয়ে রাজপথে নামতে হবে না, সমাধান নিয়ে হাজির হবেন তারা।
জামায়াতের নতুন কৌশল
জামায়াত ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরেই সীমিত ছিল। কিন্তু এখন তারা নতুন কৌশলে মাঠে নামছে। সূত্র বলছে, আসন্ন শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও বড় জেলায় ওয়াজ মাহফিল, ইসলামী জলসার আয়োজনের মাধ্যমে জনমত গঠনের চেষ্টা চালাবে তারা।
এ ধরনের ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেবেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বক্তারা—যেমন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী, আমির হামজা, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। ধর্মীয় আলোচনার ছলে সেখানে রাজনৈতিক ইস্যুতে জনমত তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এতে জামায়াতপন্থী তরুণদের মধ্যে নির্বাচনী উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে।
অন্যদিকে, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির মতো নানা নামের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে জামায়াতের সাবেক বা বহিষ্কৃত নেতারা সক্রিয় হচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন ব্যানারে থাকলেও এ দলগুলো একই কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বহির্বিশ্বকে দেখাতে চাইবে যে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন রয়েছে।
আরও পড়ুন<<>>বিএনপি পচনের নগ্ন প্রতিচ্ছবি সাবেক ইউনিয়নিস্ট বাবুল
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাব বিস্তার
বর্তমান রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়া বড় একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত শিবিরও এ প্ল্যাটফর্মকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে। তাদের সমর্থকরা নিয়মিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও, পোস্ট ও লাইভ সেশন করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি চাঁদপুরে তারেক রহমানকে নিয়ে এক জামায়াত নেতার আপত্তিকর পোস্ট ঘিরে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীরা। এতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, এসব আক্রমণাত্মক পোস্ট ও প্রচারণা শুধু তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না, বরং নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
বিএনপির সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
বিএনপির নেতারা স্বীকার করছেন যে, প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছেন। দলটির মুখপত্র ‘দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কোনো শক্তিশালী মিডিয়া তাদের হাতে নেই। সমালোচনা আছে, গণমাধ্যমের বেলায় বরাবরই কাকের বাসায় কোকিলের ডিম দেয়ার ভূমিকায় ছিল দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি। ক্ষমতায় থাকাকালে লাইসেন্স নিয়ে ফের তা বিক্রি করেছে। গণমাধ্যম হাতছাড়া করে তাদের অভিযোগ- অনেক সময় গণমাধ্যমে বিএনপির কর্মকাণ্ড বিকৃত বা আংশিকভাবে প্রচারিত হয়।
দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করতে গিয়ে সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তাদের বক্তব্য ঘিরে ট্রল ও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
একই সঙ্গে নেতাকর্মীদের অভিযোগ- দলীয় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। নির্বাচনের কাউন্টডাউন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রশ্ন উঠছে বিএনপি আসলে কৌশলগতভাবে কতটা প্রস্তুত। ডাকসু নির্বাচনের সময় যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাব ফেলেছিল, তেমন পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনের সময় আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলেই মনে করছেন তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই একক প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এ নিয়ে কাজ করছে। দলটির মনোনয়ন বোর্ডের সভা হলেই তা চূড়ান্ত করা হবে।
আরও পড়ুন<<>>খুব শিগগির একক প্রার্থীরা মাঠে নামার অনুমতি পাবেন
বহির্বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ বার্তা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের ভাঙা অংশ বা বহিষ্কৃতরা নতুন প্ল্যাটফর্ম বানালেও তাদের মূল উদ্দেশ্য একটি। তা হলো- বিশ্বকে দেখানো যে বিএনপি ছাড়া অন্য বিরোধী দলও মাঠে ইস্যুভিত্তিক সক্রিয় রয়েছে। এ বার্তা বহির্বিশ্বকে দেয়া হলে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি হতে পারে। যেমনটি দেখা গেছে ডাকসু নির্বাচনে। সরাসরি ছাত্র শিবিরের ব্যানারে তারা নির্বাচন করেনি। আর ড্যামি প্রার্থী রেখেছে একাধিক পদে। নির্বাচনের প্রচারণাকাল ছাড়াও ভোটের দিন সকাল থেকে বিকেল নাগাদ ড্যামিরা ছাত্রদলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন।
তবে বিএনপি এ ধরনের কৌশল মোকাবিলায় কোনো সমন্বিত রূপরেখা এখনও প্রকাশ করতে পারেনি। তাদের ভেতরেও বিভক্তি ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনেক কর্মী মনে করেন, নেতাদের অবস্থান ও যথাযথ প্রস্তুতির অভাব দলের ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
বাংলাদেশের রাজনীতি সবসময় অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। বিএনপির সামনে যেমন কম বেশি সরকারের চাপ রয়েছে, তেমনি সাবেক মিত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা জামায়াতও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াতের প্রভাব, মাঠে তাদের ওয়াজ মাহফিল কৌশল এবং বহির্বিশ্বের কাছে বার্তা দেয়ার চেষ্টার কারণে বিএনপিকে বহুমুখী চাপে পড়তে হচ্ছে।
বিএনপি যদি সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারে এবং মাঠে কর্মীদের উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের লড়াইয়ে তারা অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। অন্যদিকে জামায়াত ও তাদের সহযোগী প্ল্যাটফর্মগুলো জনমত প্রভাবিত করতে পারলে নির্বাচনের সমীকরণ কাটাছেড়া হতে পারে।
সব মিলিয়ে, বিএনপির ভেতরে-বাইরে এক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে—রাজনৈতিক বেরিকেড ও চাপ মোকাবিলায় তারা আসলেই কতটা প্রস্তুত?
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।