Apan Desh | আপন দেশ

এনসিপি থেকে আরেক নেতার পদত্যাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, আপন দেশ

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৮:৪৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

এনসিপি থেকে আরেক নেতার পদত্যাগ

আরিফ সোহেল

জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্যসচিব আরিফ সোহেল পদত্যাগ করেছেন। 

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সংগঠনটির যুগ্ম সদস্য সচিবের পদে থাকা এ তরুণ নেতা ফেসবুকে নিজের পেইজে দীর্ঘ এক বিবৃতির মাধ্যমে তার এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

বিবৃতিতে আটটি পয়েন্টে আরিফ সোহেল এনসিপির বর্তমান রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ও  গণমানুষের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে প্রথাগত রাজনীতির বাইরে গিয়ে পুনরায় জনগণের কাতারে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

১. 
২০১৫ সাল, শাহবাগ তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিজয়ী হেজেমন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ-ভারতীয় আধিপত্যবাদ সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক ভাবে দেশে হেজেমনিক আধিপত্য কায়েম করেছে। কিশোর-তরুণেরা এপলিটিকাল প্রজেক্টের সফল প্রোডাক্টস হয়ে কোনোমতে টিকে থাকতে শিখে গেছে। সাহসী আর ডানপিটে পোলাপান যা ছিল তারা কিশোর গ্যাং, মাদক আর অস্ত্রবাজীতে ব্যস্ত! এ অন্ধকার সময়ে রক্তক্ষয়ী কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একদল কিশোরের গভীরতম রূপান্তর ঘটে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক সকল প্রকার অথোরিটির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্রোহের ভ্রূণ আকার পেতে থাকে। তারা পলিটিক্যাল হইয়া ওঠে!

২.
২০১৭ সাল। কিশোরগুলো তখন তরুণ। একটা দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক আর সামাজিক জার্নির মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে। দেশে একটা ফ্যাসিবাদী ও বৈদেশিক আধিপত্যবাদী শক্তি জালেমী ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছে এবং এ ব্যবস্থার সমূলে উৎখাত ছাড়া দেশের মানুষের এবং তাদের নিজেদেরও মুক্তি সম্ভব নয় এইটা তারা বুঝতে শিখেছে। বার্থ বিপ্লবী পূর্বপুরুষদের সিলসিলায় জমা ধুলো সরায়ে নতুন লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছে তারা।
সদ্য তরুণেরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সশস্ত্র গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, আওয়ামীলীগ আর ভারতীয় আধিপত্য উৎখাত করতে হবে। প্রথাগত রাজনীতি, পাতানো নির্বাচন দিয়ে ফ্যাসিজমের পতন ঘটবে না। সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার লড়াইয়ে এ তরুণেরা সংকল্পবদ্ধ হয়। 

৩.
আমি, আরিফ সোহেল, এ তরুনদেরই একজন। আমার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু ২০১৭ সাল থেকে। কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা সংগঠন থেকে নয় বরং একেবারেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে গঠিত একটি গোপন বিপ্লবী সেল থেকে যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে অসংখ্য মেধাবী, সম্ভাবনাময় ও বিপ্লবী তরুণদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে এবং তাদের সংগঠিত করে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে বৈপ্লবিক রাজনীতির দিশা নির্মাণ করতে কাজ শুরু করি। একই সময়ে আমার কমরেডগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরো নানা স্থানে ও প্রতিষ্ঠানে একই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। 
প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে  একটি এক্টিভিস্ট প্লাটফর্মে (মুক্তিফোরাম) জড়ো হয়ে বিকল্প ধারার রাজনীতি করতে আগ্রহী অনেকের সাথেই যুক্ত হই। পরবর্তীতে এক্টিভিজম থেকে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হই ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন', জাতীয় সমন্বয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে। প্রথাগত ক্ষমতা পরিবর্তনের রাজনীতি এড়ায়ে রাষ্ট্রকে সংস্কার করে গণতান্ত্রিক করে তোলার লড়াইকে সে মূহুর্তে আমরা প্রকাশ্য জাতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে বৈপ্লবিক পজিশন হিসেবে রীড করে তার পক্ষে অবস্থান নেই। 
পরবর্তীতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই ক্রমান্বয়ে র‍্যাডিক্যাল টার্ন নিতে থাকলে বিএনপিসহ প্রায় সকল বৃহৎ দল এ সংস্কারের রাজনীতিকে গ্রহণ করে।

৪. 
ছাত্র রাজনীতি নির্মাণের প্রশ্নে আমরা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ছাত্র সংগঠনের পক্ষে ছিলাম। ফ্যাসিবাদের পতন তরুণেরাই ঘটাবে কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন পড়বে বৃহৎ বিক্রি হয়ে যাওয়া, অক্ষম রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে তরুণদের নিজেদের রাজনৈতিক কন্ঠস্বর ও লড়াইকে মূর্ত করে তুলতে পারার মতো সংগঠন। স্বাধীন ছাত্র সংগঠনের প্রশ্নে দ্বিমত হওয়ায় আমরা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন থেকে বের হয়ে আসি। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কমরেডদের মধ্য দিয়ে নাহিদ ভাই, মাহফুজ, আখতার ভাই ও আসিফদের উদ্যোগের সাথে আমরা যুক্ত হই এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ গড়ে তুলি।
জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন শুরু হলে অতি দ্রুতই আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই।

৫.
ফ্যাসিবাদী শক্তির হামলার মুখে ১৫ই জুলাই আন্দোলন র‍্যাডিক্যাল দিকে মোড় নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে সংগঠিত হয়ে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৫ই আগস্ট পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু আমলাতন্ত্র, বৈদেশিক শক্তির ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনা সেইফ এক্সিট নিয়ে পালালে সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠিত না হয়ে পরিস্থিতি ‘নেগোশিয়েটেড সেটেলমেন্টে’র দিকে আগায়।

৬.
জুলাইয়ে বাংলাদেশে আমরা ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর’ আবির্ভাব দেখেছি। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত প্রেফারেন্সের ঊর্ধ্বে উঠে  সকলের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছি৷ 
বৈদেশিক আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের দালালেরা জাতিকে নানা প্রশ্নে বিভক্ত রেখে বাংলাদেশে এ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নির্মিত হতে দেয় নাই। এ বিভাজন আমাদের চোখে বৈদেশিক শক্তির চেয়েও বড়ো শত্রু করে তুলেছে দেশীয় আত্মীয়, ভাই, বোনদেরকেই যারা কেবল ভিন্ন মত পোষন করেন। আর ভিন্ন মত দমনের প্রয়োজনে বৈদেশিক শক্তির তাবেদারী আর গোলামিকেও জায়েজ করেছে এ অনৈক্য, বিভাজন। 
জুলাইয়ে উদিত হওয়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সুদৃঢ় করা ও নেগোশিয়েটেড সেটেলমেন্টের পেছনে আশ্রয় নেওয়া ফ্যাসিবাদের দোসর, বিদেশী এজেন্টদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করাটাই জুলাই পরবর্তীতে আমাদের কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়। এ লক্ষ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যুক্ত হই।

৭.
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়েই আমরা এ ঐতিহাসিক জাগরণের স্বতঃস্ফুর্ত চরিত্রকে বুঝতে শিখি। আমাদের মতো অনেকগুলো ছোটো ছোটো কিশোর-তরুণদের স্বতঃস্ফুর্তভাবে তৈরি হওয়া গ্রুপ আর এলায়েন্স আন্দোলনকে গভীরতর জনসম্পৃক্ততার দিকে নিয়ে যায়। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো আর তাদের প্রক্সির বাইরে গিয়েও এ স্বাধীন, স্বতন্ত্র, প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলো (Centers of Resistance) জুলাইয়ে আন্দোলন মোবিলাইজেশন থেকে শুরু করে বুলেটের মুখে সম্মুখ লড়াইয়ে ভূমিকা রেখে জুলাইকে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নিয়ে সত্যিকার গণচরিত্র দেয়, ফলে অভ্যুত্থান প্রায় বিপ্লবের দিকে ধাবিত হয়।
জুলাইয়ের পরে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে জন্ম নেয়া, তীব্র রক্তক্ষয়ী গণসংগ্রামের উদর থেকে প্রসব হওয়া নতুন গণ রাজনীতি ও তৃতীয় শক্তিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির বাতাবরণে সংগঠিত করা সম্ভব হয় নি। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠন সম্ভব হয় নি। ফলে বিভাজন আবার ফিরে এসেছে এবং পুরনো দলগুলোর আপসরফার রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নেগোশিয়েটেড সেটেলমেন্ট নিরাপত্তা লাভ করেছে এবং ফ্যাসিবাদের দোসরেরা বেঁচে গিয়ে রাষ্ট্রকে পুনরায় গণবিরোধী করে তুলেছে।
প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ক্ষমতার কুরসীটাই প্রধান। রাষ্ট্রের চরিত্র যতো গণবিরোধীই থাকুক না কেনো, আমলাতন্ত্র উপনিবেশিক জুলুম চালিয়ে যাক না কেনো তাতে এদের কিছুই আসে যায় না যদি তারা শুধু ক্ষমতার আসনে গিয়ে বসতে পারে।
প্রথাগত পুরনো দলগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভালো সেটাও মন্দের ভালো, ছোটো শয়তান হলেও শয়তান বটে!

৮.
নতুন গণরাজনীতি, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নির্মাণ ও জুলাইয়ের গণশক্তিকে সংগঠিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালিত না হওয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রতিষ্ঠিত পুরোনো দলগুলোর সঙ্গে আপসরফা করে পুরনো ক্ষমতার রাজনীতিতেই প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। 
আমি, এবং আমার কমরেডরা গণমানুষের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের যে লড়াই শুরু করেছিলাম তা চালিয়ে যেতে হলে এ মূহুর্তে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে গিয়ে পুনরায় গণমানুষের কাতারে দাঁড়ানোর কর্তব্য অনুভব করছি।
ফলশ্রুতিতে আমি, আরিফ সোহেল, জাতীয় নাগরিক পার্টি'র যুগ্ম সদস্য সচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি'র পদ থেকে পদত্যাগ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার পূর্বতন রাজনৈতিক দল ও সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক শুভকামনা জ্ঞাপন করছি এ আশা করছি যে তারা অচিরেই নতুন রাজনীতি নির্মাণের লড়াইয়ে গণমানুষের কাতারে ফিরে আসবেন!
চলমান লড়াইয়ে আপনাদের সকলের দোয়া ও আন্তরিক শুভেচ্ছা কামনা করছি।

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

Advertisement

জনপ্রিয়