Apan Desh | আপন দেশ

জামায়াত জোটে এনসিপি, মুখ ফিরাল জুলাই প্রজন্ম

রাজনৈতিক প্রতিবেদক, আপন দেশ

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫

জামায়াত জোটে এনসিপি, মুখ ফিরাল জুলাই প্রজন্ম

ফাইল ছবি

জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোট গড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিজেই গভীর সংকটে পড়েছে। একের পর এক তরুণ ও নারী নেতা দল ছাড়ছেন কিংবা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া প্রজন্ম এ জোটকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পুনর্বাসন হিসেবে দেখছে, যা আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটব্যাংকের একটি স্পষ্ট ও কঠোর বার্তা বহন করছে।

২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের দৃশ্য এখনও বহু মানুষের চোখে ভাসে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাতে আন্দোলনকারীদের তুলে নেয়া, নির্যাতন ও স্বীকারোক্তি আদায়ের সেই ছবি শুধু একটি সরকারের দমননীতির প্রমাণ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের জন্মের দলিল। সে আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন নুসরাত তাবাসসুমের মতো নারীরা- যাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আত্মা।

এ গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং ছাত্র–তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন তৈরি হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে সে স্বপ্নের বাহক হিসেবে- মধ্যপন্থা, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চর্চা ও বাংলাদেশপন্থার অঙ্গীকার নিয়ে। কিন্তু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনি জোট সে স্বপ্নে বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে।

জামায়াতের সঙ্গে জোটের ঘোষণা আসার পরপরই এনসিপির প্রগতিশীল অংশ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। দলের ভেতরেই অসন্তোষ, ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। বিশেষ করে তরুণ ও নারী নেতাদের মধ্যে এ সিদ্ধান্তকে দেখা হচ্ছে আদর্শিক বিচ্যুতি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস হিসেবে। ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই সে প্রতিক্রিয়া রূপ নেয় পদত্যাগ, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হওয়ার ঘটনায়।

এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম জোটকে বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে নেয়া সিদ্ধান্ত বলে ব্যাখ্যা করলেও প্রগতিশীল নেতাদের বক্তব্য ভিন্ন। তাদের মতে, জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা কেবল একটি নির্বাচনি কৌশল নয়- এটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তরুণদের কাছে জামায়াত মানেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং নারী অধিকারের বিরোধী অবস্থান।

এ বাস্তবতার সবচেয়ে শক্ত প্রকাশ ঘটে এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক নুসরাত তাবাসসুমের সিদ্ধান্তে। তিনি জামায়াত-জোটের প্রতিবাদে দলের সব নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করার ঘোষণা দেন। তার ভাষায়, এনসিপি জন্মলগ্নে যে গণতন্ত্র, নয়া বন্দোবস্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, এ জোট সেই স্বপ্নের সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।

আরও পড়ুন<<>> ভোটের হাওয়ায় দ্রুত বদলাচ্ছে রাজনৈতিক সমীকরণ

একই কারণে দল ছাড়েন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ও তার স্বামী খালেদ সাইফুল্লাহ। ঢাকা-৯ আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েও ডা. জারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তিনি কোনো দল বা জোটের হয়ে নয়, বরং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি করতে চান। এটি তরুণ ভোটারদের সে আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন- যেখানে নৈতিকতা ক্ষমতার চেয়েও বড়।

ডা. তাজনূভা জাবীনের পদত্যাগ এনসিপির ভেতরের ক্ষোভকে আরও নগ্নভাবে সামনে আনে। তিনি বলেন, আপত্তির মূল জায়গা শুধু জামায়াতের ইতিহাস নয়, বরং যে গোপন ও পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় জোটের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মতে, পুরো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রাজনীতিকে কৌশলের নামে জামায়াতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, যা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না।

খাগড়াছড়ির মনজিলা সুলতানা ঝুমা এবং নওগাঁ-৫ আসনের মনিরা শারমিনের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোও একই রাজনৈতিক বার্তা দেয়। মনিরা শারমিন স্পষ্টভাবে বলেন, মানুষ এনসিপিকে অনুদান দিয়েছে তার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য, জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার জন্য নয়। তিনি অনুদানের অর্থ ফেরত দেয়ার ঘোষণাও দেন, যা নতুন রাজনীতিতে নৈতিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও জামায়াতের সঙ্গে এ জোটে যাননি। তার অবস্থান তরুণদের মধ্যে আরও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে- জুলাইয়ের রাজনীতি জামায়াতঘেঁষা নয়; বরং তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে প্রোথিত।

সব মিলিয়ে এনসিপির বর্তমান সংকট একটি বড় রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরছে। আগামী নির্বাচনে তরুণরা কেবল ক্ষমতার হিসাব কষবে না। তারা বুকে ধারণ করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ। জামায়াতের প্রতি তরুণ ও বিশেষ করে নারীদের ঘৃণা, আর এনসিপির জোট সিদ্ধান্তের পর তাদের একে একে সরে যাওয়ার ঘটনা- এ প্রজন্মের স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানই জানান দিচ্ছে।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

Advertisement

জনপ্রিয়