Apan Desh | আপন দেশ

এফবিসিসিআই নেতৃত্বে দূরদর্শী কৌশল গঠন এখনই জরুরি

আতিকুর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৮ মে ২০২৫

আপডেট: ২০:৪৬, ২৮ মে ২০২৫

এফবিসিসিআই নেতৃত্বে দূরদর্শী কৌশল গঠন এখনই জরুরি

আতিকুর রহমান।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ রূপান্তর নিঃসন্দেহে একটি গর্বের বিষয়। তবে এর পরবর্তী ধাপে রয়েছে একাধিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ। “গ্রাজুয়েশন” শব্দটির ঐতিহ্যবাহী উল্লাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু কঠিন বাস্তবতা। যা অগ্রিম না ভাবলে আমাদের রফতানিনির্ভর অর্থনীতি ও কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজকে একই সঙ্গে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। 

এ পর্যায়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই-এর আসন্ন নির্বাচন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনা নয়, বরং এক কৌশলগত দীপ্তি-বিন্দু। যেখান থেকে নেতৃত্বের মান নির্ধারণ করবে উত্তরণের পথচিত্র।

‌ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি-ইবি, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি বড় বাজারে আমরা “শূন্য শুল্ক-কোটা মুক্ত (ডিএফকিউএফ)” প্রবেশাধিকার উপভোগ করি। ২০২৬-এর পর পর্যায়ক্রমে এ ছাড় কমে গেলে তৈরি পোশাক, হোম-টেক্সটাইল, চামড়া-পণ্য ও হালকা প্রকৌশল খাত একযোগে আঘাত পাবে। 

এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ জানায়, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় না গড়ে রফতানি বাজারে ৫–১৪ শতাংশ পর্যন্ত ধস নামতে পারে। এদিকে TRIPS ছাড় ২০৩৩-এ শেষ হলে ওষুধ শিল্পকে বিপুল রয়্যালটি খরচ গুনতে হবে। যা বিদ্যমান উৎপাদন-মূল্য কাঠামো বদলে দেবে।

কৃষি জিডিপির ১৪ শতাংশ ও কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ জোগায়। এ খাতে ভর্তুকি সীমিত হলে সারের দাম বাড়বে, উৎপাদন খরচ উর্ধ্বমুখী হবে; খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি হবে। একইসঙ্গে জলবায়ু অর্থায়নে অগ্রাধিকার হারালে দুর্যোগ-সচেতন অবকাঠামো তৈরি ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ রফতানি-শোক ও অভ্যন্তরীণ খাদ্য-নিরাপত্তা, দুটোই চাপের মুখে পড়বে।

ব্যবসায়ী-রাজনীতি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, ব্যাংক খাত দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, অর্থপাচার ও রাজনৈতিক অস্থিরতার দীর্ঘ ছায়া অর্থনীতিকে এক বিরাট সংকটে ঠেলে দিয়েছিল। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যূন্থানের পর কার্যকর শাসন ও বৈদেশিক ঋণ শোধে শৃঙ্খলা ফিরেছে; রিজার্ভ আবার বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি মোড় ঘুরিয়েছে। যদিও এখনো শিল্পকারখানায় গ্যাস ঘাটতি, বিনিয়োগ নিষ্ক্রিয়তা ও কর্মসংস্থান সংকোচন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে আরও সময় লাগবে।

এফটিএ-পিটিএ: হারানো সুবিধার বিকল্প
ভিয়েতনামের মত একটি দেশ ইতোমধ্যেই ৪০-এর বেশি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশের নাম সেখানে শূন্য—খুব সম্প্রতি ভুটানের সঙ্গে একটি পিটিএ স্বাক্ষর ছাড়া। এলডিসি-উত্তর বাস্তবতায় ফিট থাকতে হলে আমাদেরকেও অন্তত মূল রফতানি গন্তব্যগুলো—ইইউ, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপানের সঙ্গে—বহুপাক্ষিক বা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দাঁড় করাতে হবে। এর নীতিক ও কূটনৈতিক মহাপরিকল্পনা যত দ্রুত শুরু হবে, তত কম দামে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো যাবে “মেইড ইন বাংলাদেশ” পণ্য। যে কারণে এফবিসিসিআই নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ?

এফবিসিসিআই কেবল “ছাদের ভেতর পেয়ারা” সংগঠন নয়; দেশের ৪.৫ কোটি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার সমষ্টিগত পালস। এলডিসি প্রকল্প সম্পূর্ণ হওয়ার পর প্রথম পূর্ণকালীন মেয়াদে সংগঠনটি সরকার, উন্নয়ন সহযোগী ও বহুজাতিক ক্রেতাদের সামনে বাংলাদেশের স্বার্থ তুলে ধরবে। সুতরাং নির্বাচিত পরিচালকরা যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ন্যায় আর অভ্যন্তরীণ সংস্কার—দুই কৌশল সাজাতে ব্যর্থ হন, পুরো বাণিজ্যিক তরী ঝুঁকির মুখে পড়বে।

আগামী দিনের নেতৃত্বে যে-সব গুণ থাকা জরুরি
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দের যে-সব গুন অপরিহার্য। 

প্রথমত; আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে ভালো জানাশুনা: বিশ্ববাজারে শুল্ক, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বা পরিবেশগত শর্ত সবসময় বদলে যাচ্ছে। তাই নেতাদের এসব নিয়ম-কানুন ভালোভাবে জানতে হবে। কার্বন শুল্ক বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত; সরকার ও বৈদেশিক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও লবিং করার দক্ষতা: রফতানি সুবিধা ধরে রাখতে হলে জিএসপি-প্লাস, জাপানের ইপিএ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝে কাজ করতে হবে। এজন্য দরকার কৌশলী যোগাযোগ ও দরকষাকষির ক্ষমতা।

তৃতীয়ত; সততা ও সুশাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতি: ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অতীতে যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, সেটা আর চলতে দেয়া যাবে না। নতুন নেতৃত্বকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানদণ্ডে অটল থাকতে হবে।

চতুর্থত; ডিজিটাল প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা ধারণায় অভ্যস্ততা: উৎপাদন খরচ কমাতে ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি (যেমন: অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ও কার্বন-কম উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই।

করণীয় পথনকশা
একীভূত নীতি সেল গঠন—এফবিসিসিআই, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত টাস্কফোর্স দ্রুত সম্ভাব্য চুক্তিগুলোর “কস্ট-বেনিফিট” বিশ্লেষণ শেষ করুক।

রফতানি ভর্তুকির স্মার্ট রূপান্তর—ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পাশাপাশি গবেষণা, দক্ষতা উন্নয়ন ও বাজার-বৈচিত্র্যে প্রণোদনা সিস্টেম। কৃষি-প্রণোদনা—সরাসরি ভর্তুকি হ্রাসের পরিবর্তে উৎপাদনশীলতা ও কার্বন সাশ্রয়ের মাপকাঠিতে প্রণোদনা। সুশাসন চুক্তি—ব্যাংকিং ও করব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে ব্যবসায়ী নেতারা স্বাক্ষরিত নৈতিক ঘরানার এক প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করুন।

লেখক; আতিকুর রহমান, আহবায়ক  মিডিয়া ও লিয়াজোঁ কমিটি  বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ (এফবিসিসিআই)

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়