
ফাইল ছবি
ইসলাম আমাদের নিজেদের উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হওয়া। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম আমাদের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সে নির্দেশনাগুলোর উপর ভিত্তি করে এখানে ১০টি উপায় আলোচনা করা হলো। যা আমাদের জীবনকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে।
১. আরও ধৈর্যশীল হোন
কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেন, ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (সুরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬)
রাসূল (সা.) বলেছেন, কারও জন্য ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও মহান কোনো নেয়ামত দেয়া হয়নি। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৬৯)
জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ, ব্যক্তিগত সংগ্রাম বা বাইরের প্রতিকূলতার মুখে ধৈর্য ধারণ করা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধৈর্যশীল হওয়ার মাধ্যমে আমরা মানসিক শান্তি লাভ করি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। যখন আপনি রাগ বা হতাশা অনুভব করেন, তখন গভীরভাবে শ্বাস নিন, ওজু করুন ও ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ুন। এটি আপনার ধৈর্য ধরতে সাহায্য করবে।
২. বেশি দান করুন
কুরআনে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তারা যেন একটি বীজের মতো, যা সাতটি শীষ জন্মায়, প্রতিটিতে একশত দানা থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬১)
দান শুধু আর্থিক সহায়তা নয়। একটি হাসি, একটি সদয় আচরণ বা কোনো বিপদে কাউকে সাহায্য করাও দানের অংশ। নিয়মিত দান আমাদের অন্তরকে পবিত্র করে এবং সমাজে ঐক্য ও সম্প্রীতি বাড়ায়। প্রতি মাসে নিয়মিত সদকা দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আলাদা করে রাখুন। এমনকি অল্প পরিমাণ দানও আল্লাহর কাছে অনেক মূল্যবান।
৩. বেশি করে দোয়া করুন
আল্লাহ বলেন, যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, (তাদের বলো) আমি সত্যিই তাদের কাছাকাছি। আমি প্রত্যেক আহ্বানকারীর প্রার্থনা শুনি যখন সে আমাকে ডাকে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
রাসূল (সা.) বলেছেন, দোয়া হলো সকল ইবাদতের মগজ। (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ৫২৬৪)
প্রতিদিন সকালে বা রাতে অন্তত ৫ মিনিট সময় নিয়ে দোয়া করুন। কুরআনের ছোট ছোট দোয়া মুখস্থ করুন, যেমন – রব্বানা আতিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আজাবা–ন্নার (হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ দান করুন ও দোজখের আগুন থেকে আমাদের বাঁচান)।
৪. নামাজের প্রতি মনোযোগী হোন
কুরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই নামাজ মুমিনদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ করা হয়েছে। (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩)
নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি ও আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। নিয়মিত ও মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করলে আমাদের ঈমান আরও মজবুত হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি তৈরি করুন এবং মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করুন, যাতে কোনো ওয়াক্তের নামাজ ছুটে না যায়। নামাজের আগে ধীরে সুস্থে ওজু করুন ও একাগ্রতা (খুশু) বাড়াতে ধীরে ধীরে সূরাগুলো পড়ুন।
৫. নিজেকে শিক্ষিত করুন
আল্লাহ বলেন, পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সুরা আল-আলাক, আয়াত: ১)
রাসূল (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ২২৪)
ইসলামে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। জ্ঞান আমাদের ধর্ম, ইতিহাস ও বিশ্ব সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি দেয়। প্রতি সপ্তাহে ইসলামী বই পড়ার জন্য কিছু সময় বের করুন। সিরাতুন নবী (সা.) বা কুরআনের তাফসির দিয়ে শুরু করতে পারেন।
৬. রাগ নিয়ন্ত্রণ করুন
রাসূল (সা.) বলেছেন, শক্তিশালী ব্যক্তি সে নয়, যে কুস্তিতে জয়ী হয়; বরং শক্তিশালী সে, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১১৪)
আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয় ও সে যদি দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ না কমে, তবে সে যেন শুয়ে পড়ে। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৭৮২)
রাগ নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের নফসের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে ও সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। যখন রাগ আসে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম পড়ুন ও আপনার অবস্থান পরিবর্তন করুন।
৭. গীবত থেকে বিরত থাকুন
আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো দুষ্ট লোক তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে, তবে তোমরা তার সত্যতা যাচাই করো, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কাউকে ক্ষতি না করো ও পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে না হয়। (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৬)
গীবত বা পরচর্চা একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এটি অন্যের সম্মান নষ্ট করে ও সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। যখন কোনো কথোপকথনে অন্যের সমালোচনা শুরু হয়, তখন বিষয়টি পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন অথবা নীরব থাকুন। নিজেকে বারবার স্মরণ করান যে গীবত করা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।
৮. বেশি কুরআন পড়ুন
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, একটি কিতাব (কুরআন) যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা করে ও বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা সাদ, আয়াত: ২৯)
রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন সুন্দরভাবে ও শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করে, সে সম্মানিত ও নেককার ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট করে কুরআন তেলাওয়াত করে, তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৯৩৭)
কুরআন তিলাওয়াত আমাদের আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ককে গভীর করে ও মানসিক প্রশান্তি দেয়। প্রতিদিন অন্তত ৫ মিনিট কুরআন তিলাওয়াত করুন। বাংলা তাফসির পড়লে এর অর্থ বোঝা আরও সহজ হবে।
৯. আরও ক্ষমাশীল হোন
কুরআনে বলা হয়েছে, তারা যেন ক্ষমা করে এবং উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা আন-নূর, আয়াত: ২২)
কাউকে ক্ষমা করা কঠিন হতে পারে। কিন্তু এটি আমাদের অন্তরকে হালকা করে ও আল্লাহর রহমতের পথ খুলে দেয়। যখন কেউ আপনার সাথে খারাপ আচরণ করে, তখন তাদের জন্য দোয়া করুন ও আল্লাহর কাছে তাদের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করুন। এটি আপনার হৃদয়ে ক্ষমার মনোভাব তৈরি করবে।
১০. আল্লাহকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু রাখুন
কুরআনে বলা হয়েছে, আমি তোমার আগে যে রাসূল পাঠিয়েছি, তাকেও বলেছি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, সুতরাং কেবল আমারই ইবাদত করো।’ (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫)
তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ ইসলামের মূল ভিত্তি। জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহকে স্মরণ করা ও তার সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা আমাদের জীবনকে একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য দেয়। প্রতিদিনের কাজ শুরু করার আগে "বিসমিল্লাহ" বলুন, নিয়ত করুন যে আপনার কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
কীভাবে এ অভ্যাসগুলো ধরে রাখবেন?
নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তোলা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করুন, যেমন দিনে একটি নতুন দোয়া মুখস্থ করা বা মাত্র ৫ মিনিট কুরআন পড়া। একটি জার্নালে আপনার অগ্রগতি লিখে রাখতে পারেন ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে তা পর্যালোচনা করতে পারেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, কর্মের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)। তাই এ অভ্যাসগুলো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গ্রহণ করুন।
উত্তম মুসলিম হওয়ার জন্য ধৈর্য, দান, দোয়া, নামাজ, শিক্ষা, রাগ নিয়ন্ত্রণ, গীবত পরিহার, কুরআন তিলাওয়াত, ক্ষমা ও আল্লাহর একত্ববাদের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। এ ১০টি উপায় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আমাদের জীবনকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকভাবে উন্নত করতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন সামান্য কিছু করে এগিয়ে যান ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।