Apan Desh | আপন দেশ

বাকৃবির গবেষণা 

চা পাতার নির্যাসে ‘জারবেরা’র জীবনকাল বাড়বে দ্বিগুণ

বাকৃবি প্রতিনিধি:

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ১৮ জুলাই ২০২৫

চা পাতার নির্যাসে ‘জারবেরা’র জীবনকাল বাড়বে দ্বিগুণ

ছবি : আপন দেশ

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় কাটফুল ‘জারবেরা’, যা বারবার্টন ডেইজি, আফ্রিকান ডেইজি বা ট্রান্সভাল ডেইজি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জারবেরা ফুলের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজ্জ্বল রঙ ও আকর্ষণীয় গঠনবৈচিত্র্যের কারণে এ ফুলটি সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসা-বাড়ি, হোটেল, অফিস কিংবা অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জায় জারবেরা একটি জনপ্রিয় শোভাদায়ক ফুল হিসেবে বিবেচিত। 

বিশেষ করে বিয়ে, জন্মদিন, কর্পোরেট প্রোগ্রাম ও বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে তোড়া, দেয়াল ও টেবিল সাজানোর ক্ষেত্রে এ ফুলের চাহিদা উল্লেখযোগ্য। ইউরোপের এ ফুল এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে যশোর, গাজীপুর ও ঢাকার সাভারের বেশ কিছু এলাকায়। তবে এ ফুলটি কাটার পর এর স্থায়িত্ব বেশিদিন টিকে না। 

এ সমস্যা দূরীকরণে চা পাতার নির্যাস ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে সিলভার অণুকণা (ন্যানোকণা) তৈরি করে এ সৌন্দর্যবর্ধক জারবেরা ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সিলভার ন্যানোকণা ফুলের দেহে জীবাণুর বিস্তার রোধ করে, পানির শোষণ বাড়িয়ে দীর্ঘ সময় ফুলকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাকৃবির ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন। গবেষক দলে একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আরেফিন যুথি (বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ফাইটো ন্যানো কণা নিয়ে কাজ করেছেন) সহ আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন।

‘চা পাতার নির্যাস ব্যবহার করে রূপার অণুকণার পরিবেশবান্ধব সংশ্লেষণ, বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ ও জারবেরা ফুলের স্থায়িত্বে এর প্রয়োগ’ শীর্ষক এ গবেষণা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'পোস্টহারভেস্ট বায়োলজি এবং টেকনোলজি' তে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাটিতে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস)।

গবেষণাটির উদ্দেশ্য নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, জারবেরা ফুল কেটে ফুলদানিতে রাখার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। কাটার ফলে ইথিলিন নামক উদ্ভিদ হরমোন উৎপাদন বেড়ে যায়, যা ফুলের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই হরমোনের প্রভাব পাপড়ি মেলানোর ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং এতে ফুল দ্রুত বুড়িয়ে যায়। ফুল কাটার পর এর জীবনকাল হ্রাস পাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো পুষ্পদণ্ড ও পানির মধ্যে থাকা জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট বাধা, যা জল শোষণে সমস্যা তৈরি করে। সিলভার ন্যানোকণা ওই ইথিলিন তৈরিতে বাধা দেয় যা ফুলের জীবনকাল বাড়াতে খুবই কার্যকর। এরই প্রেক্ষিতে আমাদের এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।

গবেষণাটির পদ্ধতি নিয়ে সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া আরেফিন যুথি বলেন, চা পাতার নির্যাস দিয়ে তৈরি রূপার অণুকণাকে পাঁচটি মাত্রায় প্রয়োগ করা হয় ০, ৫, ১০, ২০ পিপিএম এবং তুলনামূলকভাবে ১০ পিপিএম সিলভার নাইট্রেট। এর মধ্যে ১০ পিপিএম রূপার অণুকণা সবচেয়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এতে জারবেরা ফুলের স্থায়িত্ব ৬২.২২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ফুলের সতেজ ওজন ৮৫.৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বজায় থাকে, পানির শোষণ ৪০ শতাংশ, কাণ্ডে সবুজ রঞ্জক ৪৩ শতাংশ এবং পাপড়িতে রঙীন রঞ্জক ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

গবেষক যুথি আরো যোগ করেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উক্ত মাত্রার রূপার অণুকণার প্রয়োগে ফুলদানির পানিতে কোন প্রকার জীবাণু জন্মাতে পারেনি এবং গাছের কাণ্ডে পানি চলাচলের পথও বন্ধ হয়নি। 

গবেষণায় এ অণুকণার গঠন ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণে ব্যবহৃত প্রযুক্তি নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন বলেন, অতিবেগুনি-দৃশ্যমান রশ্মি বিশ্লেষণ, ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড রশ্মি বিশ্লেষণ, শক্তি বিচ্ছুরণ বিশ্লেষণ এবং এক্স-রে গাঠনিক বিশ্লেষণ এবং চা পাতায় থাকা উপকারী উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক উপাদানগুলো নিয়েও পরীক্ষা করা হয়েছে। চা পাতার নির্যাস দিয়ে আমরা একইসঙ্গে ন্যানোকণা এবং স্ট্যাবিলাইজার দুটিই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।

সিলভার ন্যানোকণার ব্যবহারবিধি নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন জানান, ফুল কেটে ফেলার পর ওই কাটাস্থানে ন্যানোকণা মিশ্রিত পানি স্প্রে করতে হবে অথবা কাটাস্থানটি ন্যানোকণা মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে তারপর ফুলদানিতে রাখতে হবে অথবা ব্যবহার করতে হবে। ফলাফল হিসেবে ফুলের জীবনকাল অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ফুলের তোড়া তৈরির সময় ও একইভাবে ন্যানোকণা মিশ্রিত পানিতে ফুলের কাটা অংশ চুবিয়ে নিতে হবে। ভোক্তাকে একটি শিশিতে এটি দিলে উনি তা ফুলদানিতে রেখে দিতে পারবেন, এভাবে এটি ভোক্তা পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এর খরচ সর্ম্পকে তিনি বলেন, বাণিজ্যিকভাবে নিয়ে আসলে এর খরচ অনেক কম হবে। কারণ এটি খুবই অল্প পরিমাণে লাগে।

গবেষণাটির সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ড. মো. আলমগীর হোসেন জানান, পরিবেশবান্ধব এ রূপার অণুকণা ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু জারবেরা নয়, অন্যান্য ফুলেও একইরকম ফল পাওয়া সম্ভব। এটি দেশের ফুল শিল্পে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ফুলের অপচয় কমবে, লাভ বাড়বে এবং ফুল রপ্তানিতেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অবশ্যই আমরা এ ন্যানোকণাকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে পারবো এবং নির্দিষ্ট ডোজে আমরা এগুলো বাজারজাত করতে সক্ষম হবো।

আপন দেশ/জেডআই

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়