
ছবি: আপন দেশ
১৮তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ভাইভা ফলাফলে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন হাজারো পরীক্ষার্থী। এ অভিযোগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগারগাঁওয়ের এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছেন তারা। এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে টানা চারদিন অবস্থান করছেন পরীক্ষার্থী।
পরীক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা সত্ত্বেও ‘সাজানো’ ভাইভা বোর্ডের কারণে অকারণ ফেল করানো হয়েছে। তাদের উত্তর যথাযথভাবে মূল্যায়ন হয়নি ও ফলাফল পুনঃমূল্যায়নের মাধ্যমে ন্যায্য বিচার দাবি করছেন।
বরিশাল থেকে আসা ফাতিমা বেগম জানান, আমি ইসলামি স্টাডিজে প্রভাষক পদে পরীক্ষা দিয়েছি। ভাইভা বোর্ডে আমাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, যার মধ্যে চারটির সম্পূর্ণ ও একটি প্রশ্নের আংশিক উত্তর দিয়েছি। এরপরও আমাকে ফেল দেখানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ ফাতিমা বলেন, এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছি। বাবা একটি মাদ্রাসায় স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। আমার এ ব্যর্থতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি পুরো পরিবারকে হতাশ করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এনটিআরসির টেকনিক্যাল ত্রুটি ও ভাইভা বোর্ডের বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমাদের সনদ দিতে হবে, ন্যায্য বিচার চাই।
ফাতিমার মতোই নোয়াখালীর জাকির হোসেনও ফলাফল নিয়ে চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বুধবার (১৭ জুন) দুপুর দুইটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফুটপাতে থাকা একটি চায়ের দোকানে। হাতে রয়েছে একটি ফাইল—যেখানে এসএসসি থেকে কামিল পর্যন্ত পরীক্ষার সনদ ও নিবন্ধন পরীক্ষার কাগজপত্র রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ নম্বর ভাইভা বোর্ডে ১২টি প্রশ্ন করা হয়। আরবি ব্যাকরণভিত্তিক সব প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিয়েছি। উপস্থিত শিক্ষকরা খুশিও হয়েছিলেন। তবুও ফেল!
জাকির বলেন, আমি কামিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি, দাখিল-আলিমে জিপিএ ৫। নিবন্ধন পরীক্ষাও ভালো হয়েছিল। আমি প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে উপস্থিত শিক্ষকরা সন্তুষ্ট হন। তাহলে এ ফলাফল কেন? বোর্ডে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জন পাস করেছেন। অথচ আগে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতেন। এবার এটা কোন যুক্তিতে? এনটিআরসির ত্রুটির কারণে এখন শিক্ষক হিসেবে আবেদন না করে রাস্তায় আন্দোলন করতে হচ্ছে।
গত ৪ জুন এনটিআরসিএ ১৮তম ভাইভা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন বোর্ডে পাসের হারে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। কেউ কেউ বলছেন, কিছু বোর্ডে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র একজন পাস করেছেন। আবার কোনো বোর্ডে ২৯ জন পাস করেছেন—যা ফলাফলের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগের মাহমুদা খাতুন মহিলা কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও ভাইভা বোর্ডের পরীক্ষক মুফতি বদিউল আলম সরকার বলেন, আরবি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলে প্রার্থীদের ফেল করানো হয়েছে।
কিন্তু অন্য বোর্ডের পরীক্ষকেরা একমত নন। তারা জানান, একই বিষয়ের প্রার্থীদের মধ্যে ৩০ জনের ২৯ জন ফেল করানো স্বাভাবিক হতে পারে না। এটি স্পষ্ট বৈষম্য ও ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।
১৮তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার (এনটিআরসি) ভাইভা ফলাফল প্রকাশ (৪ জুন) এরপর থেকেই উত্তাল আগারগাঁও। ফলের বৈষম্য ও “টেকনিক্যাল ত্রুটি”–র অভিযোগ তুলে চার দিন ধরে বড্ড রোদ‑বৃষ্টি মাড়িয়ে আন্দোলনে আছেন দেশের নানা প্রান্তের চাকরি‑প্রত্যাশীরা।
১৮তম নিবন্ধনের ফল প্রকাশের দিনই বঞ্চিত প্রার্থীদের একটি দল সচিবালয়ে গিয়ে শিক্ষা সচিব ও এনটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে অভিযোগ ও দাবিগুলো তুলে ধরেন। একই দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কয়েক হাজার পরীক্ষার্থী এনটিআরসির সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, বুধবারও এ কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
ভাইভায় ফেল করা অধিকাংশ প্রার্থীর অভিযোগ—বোর্ডে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক তার মতাদর্শের বাইরে কাউকে পাস করাননি। অনেকে জানান, প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার পরও তাদের ফেল করা হয়েছে।
বরিশালের ফাতিমা বেগম (ইসলামি স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম শ্রেণি) কণ্ঠ থরথর করে বললেন,
“ভাইভা বোর্ডে পাঁচটি প্রশ্নের চারটির সম্পূর্ণ ও একটি আংশিক উত্তর দিয়েও ফেল! পরিবার‑ভরসা আমিই ছিলাম; এখন তাঁরাই ভেঙে পড়েছেন।”
নোয়াখালীর জাকির হোসেন (আলিম‑কামিল সব স্তরে প্রথম বিভাগ) জানালেন,
“১২ টি প্রশ্নের সবগুলো উত্তর সঠিক। বোর্ডের ৩০ জনের মধ্যে পাস মাত্র ১০ জন! গত বছর একই বিষয়ের পাসহার ছিল ৯৫ শতাংশ।”
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর প্রার্থীদের টানা অবস্থান কর্মসূচি দেখে সোমবার (১৬ জুন) বিকেল ৩ টা ৩০‑এ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ‘যমুনা’তে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলকে ডেকে পাঠানো হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন—মফিজুল ইসলাম, নিলুফা ইয়াসমিন, আজিজুর রহমান, মো. আরিফ ও ইব্রাহিম হোসেন। উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ বৈঠকে বলেন,
“দাবিগুলো শুনেছি; এনটিআরসির সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলবে।”
এর আগের দিন, এনটিআরসির (অতিরিক্ত দায়িত্ব) চেয়ারম্যান মুহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি পাঠান; একই দিন বঞ্চিত প্রার্থীরা সচিবালয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করে লিখিত অভিযোগ জমা দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি করা মাহমুদা বেগম বলেন,
ভাইভায় আমাকে ৮টি প্রশ্ন করা হয়েছিল, যার সবগুলোর উত্তরই দিয়েছি। তবুও ফেল করানো হয়েছে। এটা চরম বৈষম্য।”
তিনি আরও জানান, আমাদের বিষয়ে কোটা ছিল ৪,০০৭টি, কিন্তু ভাইভায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে এর চেয়েও কমসংখ্যক প্রার্থীকে। আমি পরিবারের বড় সন্তান। এখন চাকরি অত্যন্ত প্রয়োজন। যতদিন ফলাফল পুনর্বিবেচনা না হবে, ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাব।
চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে অনার্স পাশ করা প্রিয়াঙ্কা বলেন,
চারুকলায় এক বছরের কোর্স করে স্কুল বিভাগে পরীক্ষা দিই। ভাইভায় তিনটি প্রশ্ন করা হয়, যার মধ্যে দুটি প্রশ্নের পুরো উত্তর দিয়েছি। তবুও ফেল।
তিনি যোগ করেন, আমাদের বিষয়ে ২১ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিলেও এমসিকিউ পাস করে ৪ হাজার, লিখিত পাস করে ৬২৮ এবং ভাইভায় মাত্র ৫০৪ জন। অথচ কোটার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি ছিল। এটা সম্পূর্ণ বৈষম্য।
আরবি প্রভাষক হিসেবে পরীক্ষা দেওয়া সোহেল হোসেন জানান,
ভাইভায় আমাকে সুরা ফাতিহার অনুবাদ করতে বলা হয়, আমি পুরো অনুবাদ করি। ব্যাকরণসহ বাকি প্রশ্নগুলোরও উত্তর দিই। আমি দীর্ঘদিন একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি, তারপরও ফেল!
তিনি বলেন, দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় আমার উপজেলায় প্রথম হয়েছিলাম। দুটোতেই জিপিএ ৫ পেয়েছি। এবারের ফল আমাদের পরিবারে দুঃখ ও হতাশা এনে দিয়েছে। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এনটিআরসির এ বৈষম্য সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।