
ছবি: আপন দেশ
মাছ শিকারে গিয়ে প্রায় চার মাস সাগরে পর ফিরেছে নোয়াখালীর হাতিয়ার এমভি আহাদ-২ ট্রলারের ২১ জন জেলে। সাগরের উত্তাল তরঙ্গ আর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়কে জয় করে তারা আহরণ করেছেন প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাছ। অবশেষে ট্রলার নিয়ে তারা ফিরেছেন আপন ভিটেমাটিতে। তবে এবারের ফেরা সম্পূর্ণ আলাদা। পুরো ট্রলার সাজিয়ে, একই রকম পোশাকে, গান-বাজনাসহ উৎসবের আমেজে ঘরে ফিরেছেন এসব জেলেরা।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাগরে আজ (০৩ অক্টোবর) থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। এ আইন অমান্য করলে মৎস্য আইনে রয়েছে- সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান। তাই এ সময় পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য ঘরে ফিরেছেন জেলেরা।
সরেজমিনে হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে দেখা যায়, এমভি আহাদ-২ ট্রলারটি নানাভাবে সজ্জিত করে ফিরছেন জেলেরা। তাদের সবার গায়ে একই রকমের পোশাক, মুখে হাসি আর চোখে বাড়ি ফেরার আনন্দ। দৃশ্যটি দেখতে ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি নিষেধাজ্ঞার এ বিরতিকে জেলেরা উৎসবে পরিণত করেছেন।
জেলে মো. রাফুল বলেন, আমাদের সবার বাড়ি হাতিয়ায়। প্রায় চার মাস আমরা সাগরে মাছ শিকার করেছি। এ সময় কীভাবে কাটিয়েছি, তা আল্লাহ আর আমরা ছাড়া কেউ জানে না। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তো মনে হয়েছিল- হয়তো আর কেউই বাঁচব না, উদ্ধার হওয়ারও কোনো আশা ছিল না। তাই আজ ঘরে ফেরার আনন্দ আমাদের ভেতরে অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়েছে। সে আনন্দকে ভাগাভাগি করতেই আমরা ট্রলার সাজিয়েছি, একই রকম পোশাক পরেছি।
মো. মামুন নামে এক জেলে বলেন, মাছ ধরতে আমার ভালোই লাগে। চার মাস সাগরে থেকে মাছ শিকার করে হাতে এসেছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এ টাকায় নতুন একটি জায়গা কিনেছি। নদী ভাঙনে আমাদের আগের বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। তাই নতুন জায়গা কেনা ছাড়া উপায় ছিল না। সরকার যদি হাতিয়ার নদীভাঙন রোধে উদ্যোগ নিত, তবে আমাদের মতো জেলেদের জীবন অনেক সহজ হতো।
আরওপড়ুন<<>>‘ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হবে’
ট্রলারের মাঝি শুভ চন্দ্র বলেন, প্রায় এক দশক ধরে সাগরে মাছ ধরছি। আমাদের এমভি আহাদ-২ ট্রলারটির বয়স মাত্র চার বছর। এখানে আমরা ২১ জন জেলে মিলে রোজগারের সংগ্রাম চালাই। এ ট্রলারটিই আমাদের জীবনের ভরসা। শেষ দিনের ফেরা স্মরণীয় করে রাখতে বাড়ি ফেরার আগে আমরা পুরো ট্রলারটি সাজিয়েছি। সবাই একই ধরনের পোশাক পরেছি, যেন উৎসবের আবহ তৈরি হয়। আমাদের মালিক আরিফ মাঝিকেও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছি। এ আয়োজনের সব খরচ আমি নিজেই বহন করেছি।
ট্রলারের মালিক মো. আরিফ মাঝি বলেন, আমি ট্রলারের মালিক হলেও একইসঙ্গে মাঝিও। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এ জেলে পেশার সঙ্গেই আছি। আমাদের ২১ জন যেন একটা পরিবারের মতো। সবসময় একে অন্যের পাশে থাকি। এ বছর চার মাস সাগরে থেকে পেয়েছি প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাছ। যদিও গত বছর এ অঙ্ক ছিল প্রায় ৭০ লাখ। এবারে খরচ হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টাকা। খরচ বাদে প্রতিজনের ভাগে আসবে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। তারা সবাই খুশি হয়েছে, আর সে আনন্দের প্রকাশেই আমরা ট্রলারটিকে সাজিয়েছি।
মৎস্য ব্যবসায়ী মো. আকবর হোসেন বলেন, আজ জেলেদের বিদায়ের উৎসব। আর আগামীকাল থেকেই শুরু হবে ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের হালখাতা উৎসব। সাগর ফেরা জেলেরা অবসরের প্রথম চার-পাঁচ দিন ঘরে বসেই কাটান, কোনো কাজকর্ম করেন না। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই তারা জাল ও নৌকা মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, পাশাপাশি সামলান সংসারের অন্যান্য কাজও। এ সময় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া হয়, আবার অনেকে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিয়েশাদির আয়োজনও করেন।
চেয়ারম্যান ঘাটের আড়ৎদার মাহবুবুল আলম ইউসুফ বলেন, আগে প্রচলিত ছিল, দীর্ঘসময় সাগরে মাছ শিকারের পর জেলেরা বাড়ি ফেরার পথে নৌকা বা ট্রলার সাজিয়ে ঘরে ফিরতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সে রেওয়াজ আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবে এবার সে ঐতিহ্য আবারও জীবন্ত করে তুলেছে এমভি আহাদ-২ ট্রলার। তাদের সাজসজ্জা দেখতে চেয়ারম্যান ঘাটে উপচে পড়েছে জনতার ভিড়। এমন রঙিন সাজে সজ্জিত ট্রলার দেখতে সত্যিই এক অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি জাগে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, শুক্রবার (০৩ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মা ইলিশ রক্ষায় নদীতে কঠোর নজরদারি থাকবে। মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালাবে। আশা করি, নিষেধাজ্ঞা সফল হলে এরপর প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে। মাছ পেলে জেলে ও সংশ্লিষ্টরা উপকৃত হবে।
আপন দেশ/এমএইচ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।