
ফাইল ছবি
কালের বাম ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। সময়ের সঙ্গে সেই সংগ্রামী মুখোশ খুলে গেছে। রাজনীতিতে নেই আদর্শ—আছে টাকার বাণিজ্য, পদ লেনদেন ও স্বার্থপর আঁতাত। নতুন কমিটিতে জায়গা পেয়েছে দলের বহিষ্কৃতরা, চোর, চাঁদাবাজ আর আওয়ামী পন্থীরা।
বাইরে প্রতিপক্ষকে শত্রু বানালেও ভেতরে তাদের কাছেই হাত পেতে দেন। নিজেকে ‘হবু এমপি’ হিসেবে পরিচিত করালেও বাস্তবে তিনি অনেক আগেই টাকার এমপি হয়ে গেছেন। ছাত্রনেতা থেকে আজ মীরজাফরের ভূমিকায় পতিত বাবুল বিএনপির রাজনৈতিক পচনের নগ্ন প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার এহেন অপকর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছেন।
এ সংক্রান্ত বিস্তর অভিযোগ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব বরাবর দাখিল করেছেন মেলান্দহ বিএনপি নেতারা।
ঘটনা–১: টাকার বাণিজ্যে উপজেলা কমিটি
কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক বাবুল। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলা বিএনপির সভাপতিও তিনি। সভাপতি হওয়ার পর কমিটি গঠনে চলে কোটি টাকার কারবার। সাংগঠনিক সম্পাদক বানানো হয়েছে ঢাকায় বসবাসরত নুর নবী মণ্ডলকে। যিনি বিএনপির শুধুমাত্র সদস্য ছিলেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের ডোনার ছিলেন এই নুর নবী। মির্জা আজমের চেম্বারে সপ্তাহে একাধিকবার হাজিরা দিতেন। ব্যবসা পেতে কোটি টাকা দিয়েছেন আজম গংদের।
ঢাকায় সিএন্ডএফ ব্যবসা করা এ নুর নবীকে একলাফে মেলান্দহ উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বসিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। তাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একাধিকজন জানিয়েছেন, শত কোটি টাকার মালিক নুর নবী মন্ডল গত ১৬ বছরই মির্জা আজমের ডোনারের ভূমিকা পালন করেছেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা, কারাবাস তো দূরের কথা পুলিশের খাতায় জিডিও নেই। এ বিত্তশালী নুর নবী মাত্র ৩৪ লাখ টাকায় পদটি খরিদ করেছেন বাবুলের কাছ থেকে। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি আছে মনোনয়ন পেলে ওই সময়ও ডোনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। টাকা ছাড়া দলীয় রাজনীতি নয়- এ যেন বাবুলের নীতি।
নুর নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাই আমি ১৯৯৮ সাল থেকেই ঢাকায় চাকরি করছি, এরপর সিএন্ডএফের ব্যবসা করছি। ২০০৯ সালে আমাকে বাবুল ভাই থানা কমিটির সদস্য করেছেন। ২০১৪ সালে থানা বিএনপির প্রবাসী ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, ২০২২ সালে আহবায়ক কমিটির সদস্য করেছেন। ২০২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আমাকে প্রস্তাবে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। পদ নিতে টাকা লাগেনি।
ঘটনা–২: টাকায় বদলে যাওয়া কমিটি, আছে চোরও
মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন হাজী আব্দুস সাত্তার সভাপতি ও তৈয়বুর মাস্টার সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে বাবুল ফলাফল পাল্টে দেন। সভাপতিতে বসান তৈয়বুরকে। তিনি উউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাউর রহমান আতা মাস্টারের সহোদর। আর সম্পাদক করেন সাত্তারের ছেলে কাপড় ব্যবসায়ী বাবলুকে।
স্থানীয়দের দাবি, এ কারচুপি করতে বাবুল নিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। সভাপতির পদ বাগিয়ে তৈয়বুর এখন সালিশের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ছোট সালিশ ৫০ হাজার আর জটিল সালিশ হলে লাখ টাকা। সালিশ করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিষেধ করেছেন কিন্ত তা আমলে নেয়নি বাবুলভক্তরা। যা সরাসরি সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গ।
আরও পড়ুন<<>> বিএনপির শরিক, আওয়ামী লুটের সঙ্গী ‘ধনকুবের’ শাহাদাত সেলিম
মাহমুদপুর ইউনিয়নের নতুন কমিটির ১০১ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বিএনপিতে ঢুকেছেন।
এদিকে স্থানীয় হাজীপুর বাজার একটি ট্রাক থেকে ২৫ হাজার টাকা চুরি করে ১০ নং ঝাউগাড়া ইউনিয়ন যুবদলের আহবায়ক সোহাগ রানা উজ্জ্বলের ভাই জুয়েল রানা। পরে জনৈক নজরুল এবং জহরুলের মাধ্যমে সালিশ মীমাংসা হয়ে ২৩ হাজার টাকা ফেরত দেয়। চুরির আরেক কাণ্ড করেছেন ৯ নং ওয়ার্ডের শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কিনু মিয়ার ভাই জাকির মিয়া। তিনি একটি মাহিন্দ্র গাড়ি চুরি করেন। টাঙ্গাইল রেলওয়ে থানায় একটি জিডি করে মালিকপক্ষ। পরে গাড়ি উদ্ধার করে, জাকিরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
ঘটনা–৩: আওয়ামী যুবলীগের অধ্যক্ষের নিরাপদ আশ্রয়
হাজরাবাড়ী সিরাজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আছেন। গণআন্দোলনের সময় যিনি ভয়ে কলেজে যেতেন না। সেই যুবলীগ নেতাকেই আশ্রয় দেন, পদে বহাল করেছেন বাবুল। অধ্যক্ষকে টিকিয়ে রাখতে নেন ৪০ লাখ টাকা। এরক’দিন পরেই কলেজ কমিটির সভাপতি হন বাবুল। ফলে স্থানীয় রাজনীতিতে টাকার বিনিময়ে শত্রুকে বন্ধুর আসনে বসানো এখন ওপেন সিক্রেট।
ঘটনা–৪: চাঁদাবাজির মহোৎসব
ঢাকায় অভিজাত জীবনে থাকা বাবুল নিজের অনুগতদের মাঠে নামান চাঁদাবাজির জন্য। ঝাউগড়া বাজারে যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক রেজাউল সরকার রেজা ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ধান-চাল ব্যবসায়ী আপেল মিয়া ও সিদ্দিক মিয়া ব্যবসার ট্রাক আটকিয়ে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে দরকষাকষিতে ৫০ হাজার টাকা দেয়। তারা সটকে পড়েন। খবর পেয়ে স্থানীয় জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে চাঁদাবাজদের সহযোগিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। অথচ এ কাণ্ডে বাবুল নির্বিকার। জনতার পিঠ থেকে টাকা লুটে রাজনীতি চালানোই যেন তার চালিকা শক্তি।
ঘটনা–৫: ঘুষের টাকা ফেরত পেতে ঘুরছেন চেয়ারম্যান-মেম্বার
উপজেলার দশটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে বাবুল জনপ্রতিনিধিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রলোভন দেখান। প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ৫–৭ লাখ টাকা নেন প্রত্যেকের কাছ থেকে। কিন্তু দায়িত্ব স্থগিত হওয়ার পরও টাকা ফেরত দেননি। সোহেল মেম্বারের কাছ থেকে প্যানেল চেয়ারম্যান বানানোর নামে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে পাশা পরিবারের চেয়ারম্যান থেকে টাকা নেননি তিনি। প্রতারণাই যেন বাবুলের রাজনৈতিক মূলধন।
ঘটনা–৬: নির্বাচনে প্রতিপক্ষের সঙ্গে আঁতাত
জামালপুর-৩ আসনে বারবার আওয়ামী লীগের মির্জা আজমের কাছে হেরে গেলেও বাবুলের ক্ষতি হয়নি। অভিযোগ আছে—প্রতিটি নির্বাচনে তিনি মির্জা আজমের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী বাবুল। ভোটের দিন থেকেছেন নিষ্ক্রিয়। নিজ বাসার কাছের কেন্দ্রেও নিজের ভোটটি দিতে যাননি। নির্বাচনের পর তিন কোটি টাকায় বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট কেনা নিয়েও সমালোচনা আছে। ছাত্রনেতা বাবুল আজ আওয়ামী প্রতিদ্বন্দ্বীর ‘ভেতরের খেলোয়াড়’।
ঘটনা–৭: আ.লীগার ও বিএনপির বহিষ্কৃতদের নিয়ে কমিটি
বহিষ্কৃত ও অব্যাহতি প্রাপ্ত দুই নেতা মেলান্দহ উপজেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটিতে এখন পদধারী নেতা। উপজেলার ফুলকোচা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মতলুব হোসেন বাবু আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন। তাকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। উপজেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটিতে তাকে ৪ নং সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন<<>> আ.লীগ-জামায়াত অঘোষিত আঁতাত
জাতীয়তাবাদী যুবদল মেলান্দহ পৌর শাখার যুগ্ম আহবায়ক মো: দেলোয়ার হোসেনকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয়। তাকে মেলান্দহ উপজেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটিতে দফতর সম্পাদক পদ দেয়া হয়েছে। অব্যাহতি ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ছাড়া কিভাবে এসব নেতা কমিটিতে স্থান পেলেন তা নিয়ে দলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ প্রশ্নের জবাবে বহিষ্কৃতরা বলছে, বাবুল ভাই চেয়েছেন তাই পদ পেয়েছি। ঝাউগড়া ইউপি সভাপতি আব্দুল আলিম সরকারের ভাই আব্দুল হালিম সরকার। মির্জা আজমের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তিনিই এখন ইউনিয়ন বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক।
ঘটনা–৮: টিআর–কাবিখা লুটপাট
প্রতি প্রকল্পে ২–৬ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও বাস্তবে জনগণের জন্য থাকে মাত্র ৬০–৭০ হাজার। বাকি টাকা লুটে নেয় বাবুলের অনুসারীরা। সরকারি সুবিধা এভাবে দলীয় দুর্নীতির খাতায় পরিণত হয়েছে। টিসিবির পণ্য বিতরণ না করায় সরকারি কর্মকর্তারা তালা ভেঙ্গে চাল উদ্ধার করে সাধারণের মধ্যে বিতরণ করার ঘটনাও ঘটেছে বাবুলের এলাকায়।
ঘটনা–৯: জায়মা রহমানকে দিয়ে বানানো রিল
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো জায়মা রহমানকে ব্যবহার করে ভিডিও রিল বানানো। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাতনী ও তারেক রহমানের কন্যা জায়মাকে এডিট করে দেখানো হয়েছে বাবুলের ফলক উন্মোচন করছেন। গান বাজছে- “আমি গর্বিত আমি বাংলা মায়ের সন্তান…”। অথচ পরিবার তাকে সচেতনভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছে। এ প্রচারণায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিএনপি নেতারা। তাদের মতে, এটি জিয়া পরিবারের প্রতীকী মর্যাদার অপমান।
আরও পড়ুন<<>> ন্যাশনাল লাইফের তদন্তে দুদক: ২১শ’ অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন, ৭১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ-পাচার
দুর্বৃত্তায়ন ও নীতিচ্যুতির প্রতীক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল আজ দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক। কালের বাম ছাত্রনেতা এখন কেবল কমিশন, ঘুষ, লুটপাট আর প্রতিপক্ষের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার গল্পে চিহ্নিত। তার আশ্রয়ে অনুগতরা চাঁদাবাজ বাহিনীতে রূপ নিয়েছে। দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে তিনি চালাচ্ছেন একক কর্তৃত্ব। টাকা, ক্ষমতা ও ব্যক্তিস্বার্থের কাছে ত্যাগী কর্মীদের অবদান অবমূল্যায়িত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রাজনীতি যখন আদর্শ হারায়, তখন তা পরিণত হয় ব্যক্তিস্বার্থ আর টাকার লেনদেনের বাজারে। বাবুলের কাহিনি সেই নগ্ন সত্যের প্রতিচ্ছবি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি সময় থাকতে দুর্বৃত্তায়ন ও অনৈতিক প্রভাবকে রুখে না দাঁড়ায়, তবে শুধু মেলান্দহ নয়, গোটা দলই জনগণের আস্থা হারাবে। ইতিহাস দেখিয়েছে—যে দল জনমানুষের বিশ্বাস হারায়, তাকে আর আন্দোলন কিংবা নির্বাচনে টিকিয়ে রাখা যায় না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের মোবাইলে (০১৭১১---০৮৪) দীর্ঘদিন, একাধিকার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।