Apan Desh | আপন দেশ

রোডম্যাপ নাকি রোডব্লক!

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ৯ জুন ২০২৫

আপডেট: ১৫:৫৬, ৯ জুন ২০২৫

রোডম্যাপ নাকি রোডব্লক!

প্রতীকী কার্টুন

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান মঞ্চে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয় হলো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনার ঝড়।

প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন যে, আগামী ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ ঘোষণা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করেছে।

বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এ রোডম্যাপ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, এপ্রিল মাস ভোটগ্রহণের জন্য একেবারেই উপযুক্ত সময় নয়। মূলধারার বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি’র মতে, এপ্রিল মাসে নির্বাচন মানেই একটি সুস্পষ্ট কৌশলগত সুবিধা দেয়া, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।

বিএনপির কঠোর আপত্তি ও শঙ্কা

রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম, জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, তারা এ রোডম্যাপকে ঘোরতরভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। দলটির নেতারা বলছেন, এপ্রিল মাসে নির্বাচন মানে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, যা বাস্তবতা বিবর্জিত।

প্রথমত, জানুয়ারি মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষা থাকে। দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের আবহাওয়া বৈরী থাকে, বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। তৃতীয়ত, ২০২৬ সালের রমজান শুরু হবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। চলবে পুরো মার্চ জুড়ে। ফলে ধর্মীয় আবহে এবং জনসংযোগ সীমিত থাকার কারণে সে সময় নির্বাচন কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বিএনপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, এ নির্বাচনী রোডম্যাপ এক ধরনের ‘গোপন চুক্তি’র ইঙ্গিত বহন করছে, যা একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রণীত হয়েছে।

জামায়াত ও এনসিপি’র রহস্যময় সমর্থন

চমকপ্রদভাবে, রোডম্যাপ ঘোষণার পর একমাত্র সমর্থন এসেছে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ থেকে। দলটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার পরিকল্পনা যৌক্তিক।

এছাড়া সদ্য আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’ (এনসিপি) ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ছাত্রদের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলে ইউনূস যখন এনসিপির প্রতি সহানুভূতি দেখান, তখন থেকেই প্রশ্ন উঠে, এ দলটি কি মূলত একটি আদর্শিক ‘ছদ্মবেশ’? বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ সংগঠনটিকে জামায়াতপন্থী ছাত্রদের একটি প্রজেক্ট হিসেবে দেখছে।

একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এনসিপিকে সুযোগ দিতে এবং দেশের মূলধারার রাজনীতি থেকে জাতীয় ঐক্যের আদলে একটি "আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য" সরকার তৈরি করতেই এ সময়সূচি নির্ধারিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার কি সত্যিই নিরপেক্ষ?

ড. ইউনূস প্রথম থেকেই বলেছিলেন, তিনি কোনও রাজনৈতিক পক্ষের প্রতি অনুগত নন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার কিছু কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে সেই নিরপেক্ষতার বারবার প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক বৈঠকগুলোতেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন,গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এলডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এনসিপি, গণফোরামসহ শতাধিক দল অংশ নিলেও তারা একমত হতে পারেনি। রোডম্যাপ ঘোষণার পরে এ বৈঠকগুলোর উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের পেছনে প্রশাসনিক যুক্তির চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি জড়িত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার নির্দিষ্ট কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক মনোভাব একটি গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস দিচ্ছে।

জনগণের প্রশ্ন: রোডম্যাপ নাকি রোডব্লক?

এ পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা ছড়িয়ে পড়ছে। ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে প্রত্যাশা ছিল, তা এখন যেন চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের বিরক্তি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন—এ রোডম্যাপ আসলে নির্বাচন সহজ করার পরিকল্পনা, না কি একটি রোডব্লক?

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, যদি এ নির্বাচন আবারও একতরফা হয়, তাহলে আগামী দশ বছরেও গণতন্ত্র ফিরবে না।

সামনে অন্ধকার না আলো?

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কি না, তা এখনই বলা কঠিন। তবে যা স্পষ্ট, তা হলো এ রোডম্যাপ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

যদি এ সংকট সমাধানের জন্য দ্রুত কোনও রাজনৈতিক সমঝোতা না হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আরও অস্থির হয়ে উঠবে। আর এ অস্থিরতা কেবল রাজনীতি নয়—অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক সুনাম—সবকিছুকেই হুমকির মুখে ফেলবে।

নির্বাচনের সময়সূচি যে শুধুই একটি তারিখ নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কাঠামো নির্ধারণের অদৃশ্য খসড়া—এ সত্যটা যত দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল দেশের জন্য।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়