Apan Desh | আপন দেশ

ঢালাও জামিন পাচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২১ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ০৯:২৫, ২১ অক্টোবর ২০২৫

ঢালাও জামিন পাচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা

সংগৃহীত ছবি

জুলাই বিপ্লবের পর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার দল আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বহু নেতা-কর্মীকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মন্ত্রী থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও আছেন।

তবে আসামিদের গ্রেফতারের গতি আর তাদের জামিন পাওয়ার গতি প্রায় সমান। পুলিশ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পুলিশ বলছে, আওয়ামী আসামিরা এভাবে জামিন পেলে আগামী নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে কিছু তথ্য। ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৩০২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা-কর্মী।

তাদের গ্রেফতারের প্রধান চারটি কারণ ছিল- জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলা, বিপ্লবের পর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ঝটিকা মিছিল করে লিফলেট বিতরণ, পুরনো মামলা।

আরও পড়ুন>>>আ.লীগ-জামায়াত অঘোষিত আঁতাত: জেন-জির রক্তের সঙ্গে বেঈমানি!

ঠিক একই সময়ে ৩১ হাজার ২৭২ জন জামিন নিয়েছেন। জামিনের কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে— অসুস্থতা, বয়স্ক হওয়া ও দলীয় পদে না থাকা।

জামিনের কারণ ও বাণিজ্য

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে পারছে না পুলিশ। এছাড়া, কিছু সুবিধাবাদী আইনজীবী আছেন। তারা অর্থ নিয়ে আসামিদের জামিনে সহযোগিতা করছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে জামিনের চিত্র আরও স্পষ্ট।

রেঞ্জ গ্রেফতার (১ বছরে) জামিন
ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) ২,৮১২ জন ২,২১২ জন
ঢাকা রেঞ্জ ৬,৯২৩ জন ৪,৬১২ জন
রাজশাহী রেঞ্জ ৪,৯৩৩ জন ৩,৯৯৮ জন
খুলনা রেঞ্জ ৫,৯০১ জন ৪,৬১২ জন
বরিশাল রেঞ্জ ১,৫১২ জন ১,৪৩৩ জন
রংপুর রেঞ্জ ৩,৫৯১ জন ২,৪১৪ জন
ময়মনসিংহ ২,৯৬৬ জন ১,৩৪৩ জন
চট্টগ্রাম রেঞ্জ ৭,৫২৩ জন ৫,৮১৩ জন
সিলেট রেঞ্জ ১,২৯৮ জন ৯৮০ জন

পুলিশ ও আইনজীবীদের উদ্বেগ

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার মতে, গ্রেফতার হওয়া অনেকেই ফৌজদারী মামলার আসামি। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবে হত্যা, গুলি ছোঁড়া, হামলা, ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে।

এরা আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা-কর্মী। গত ১৫ বছরে এরাই বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। পুলিশ মনে করছে, তারা জামিনে মুক্ত হলে সমাজে আবার অস্থিতিশীলতা বাড়বে। বেড়ে যাবে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা।

পুলিশের সূত্র আরও জানায়, ফ্যাসিবাদের দোসররা এভাবে জামিন পেলে আগামী সংসদ নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র হতে পারে। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেকায়দায় পড়বে।

একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি কিছু সুবিধাবাদী আইনজীবী জামিন বাণিজ্যে জড়িয়েছেন। তারা অর্থের বিনিময়ে আসামিদের জামিনে সাহায্য করছেন। জামিন পাওয়া আসামিরা অন্য স্বজনদেরও তাদের কাছে পাঠাচ্ছেন।

ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, এখন জামিনের হার শূন্য। তবে অসুস্থ, বয়স্ক ও দলীয় পদে নেই—এমন ব্যক্তিরা জামিন পাচ্ছেন। তাদের বন্দিত্ব প্রায় ১ বছর হয়ে গেছে।

সমাজ বিজ্ঞানী ও আইজিপির মন্তব্য

অপরাধীদের এভাবে জামিনে মুক্ত হওয়া সমাজের জন্য ক্ষতিকর কি না, এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক বিভেদ তৈরি হতে পারে। পরাজিত ফ্যাসিবাদ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। জুলাই বিপ্লবে অভিযুক্তদের অভিযোগ যথাযথ তদন্ত করে জামিনসহ আইনি অধিকার বিবেচনা করা উচিত।

পুলিশ সদর দফতরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কেন আসামিরা জামিন পাচ্ছেন, সে কারণ আদালত বলতে পারবে। তবে পুলিশের কোনো দুর্বলতা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আইজিপি বাহারুল আলম এ বিষয়ে বলেন, আদালত থেকে ফ্যাসিস্টরা কেন জামিন পাচ্ছে—তা আমরা বিশ্লেষণ করব। সামনে নির্বাচন হবে। এরা বের হয়ে এলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী ৫৭০ আসামির জামিন (মৌলভীবাজার)

জুলাই বিপ্লবে মৌলভীবাজারে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলার আসামিরাও হাইকোর্ট থেকে জামিন পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় ৫৭০ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। মুক্তি পেয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্র করছেন। এতে জেলার আইন-শৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কায় জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর এ জেলায় ১ হাজার ১৭৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের প্রায় অর্ধেক জামিনে আছেন। অনেকের জামিন প্রক্রিয়াধীন। ফলে প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে।

জামিন পাওয়াদের মধ্যে মৌলভীবাজার শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা আনিসুল হক চৌধুরী তুষার আছেন। তিনি ৪ আগস্ট আন্দোলন দমাতে সরাসরি গুলি করেন। তার জামিনে জেলা শহরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এছাড়া সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বহু চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও নেতা-কর্মী জামিন পেয়েছেন।

মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, যারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাদের নামে অন্য কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ পুনরায় গ্রেফতার করতে পারছে না। জামিনের বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার।

তিনি মনে করেন, নিম্ন আদালতে সরকারি কৌঁসুলিদের বিষয়টি ভালোভাবে দেখা দরকার। এতে যারা সাধারণ মানুষের জন্য হুমকি, তাদের নিম্ন আদালতে আটকে রাখা সম্ভব হলে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হবে। বন্দি থাকা অবস্থায় বিচার কাজ শুরু করা সহায়ক হবে।

মৌলভীবাজার জেলা জজ কোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, মামলাগুলো হাইকোর্ট থেকে জামিন হচ্ছে। তার জজ কোর্ট থেকে এক বছরে একটিও জামিন হয়নি। হাইকোর্ট থেকে ৬ মাস বা চার্জশিট পর্যন্ত জামিন দেয়া হচ্ছে। এসব মামলায় চার্জশিট হয়নি। হাইকোর্ট থেকে জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে আনলে নিচের কোর্টের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না।

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়