
বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে রয়েছে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলা। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঘটনার মাত্র দুই দিন আগেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। কিন্তু এর আগেই তিনি নজিরবিহীন পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর জেরে ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে যাবেন।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর এটাই ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলিত হয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান।
এক বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, এ হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তার নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
গত সপ্তাহে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন খামেনি। তিনি বলেন, এ সংঘাতে যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ আমেরিকানদের জন্য ‘অপূরণীয় ক্ষতির’ কারণ হবে। পুরো বিশ্ব এখন তার তথা ইরানের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এ হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সারা বিশ্বে তেল পরিবহনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক পথ। হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ ২ কোটি ব্যারেল তেল এবং বিপুল পরিমাণ তরল গ্যাস পরিবাহিত হয়।
ইরান অতীতেও এ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, তবে তারা কখনওই সে হুমকি কার্যকর করেনি। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তা বৈশ্বিক বাণিজ্যকে নতুন সংকটে ফেলবে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দামে বড়সড় প্রভাব পড়বে।
-
হরমুজ প্রণালি কী?
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ বা “চোক পয়েন্ট” হিসেবে পরিচিত হরমুজ প্রণালি। কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অনেকটাই এ পথে তেল পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল।
প্রণালিটি ওমান ও ইরানের মাঝখানে অবস্থিত। এটি ওমান উপসাগর ও আরব সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এ প্রণালির সবচেয়ে সরু স্থান মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া। যার মধ্যে শিপিং লেন বা জাহাজ চলাচলের পথ মাত্র ৩ কিলোমিটার প্রশস্ত।
-
যে কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ
বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এ প্রণালি দিয়ে যায়। বিশ্লেষণ সংস্থা ভরটেক্সার (Vortexa) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে গত মাস পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ থেকে ২ কোটি ৮ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, কনডেনসেট (একটি হালকা ধরনের হাইড্রোকার্বন তরল) ও অন্যান্য জ্বালানি এ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত হয়েছে।
সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাকসহ ওপেকভুক্ত অধিকাংশ দেশ তাদের অপরিশোধিত তেল এ পথেই রফতানি করে, বিশেষ করে এশীয় দেশগুলোতে। এ অঞ্চলজুড়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের, যার ঘাঁটি বাহরাইনে অবস্থিত।
-
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে কী হবে?
প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি চাপ দেওয়ার একটি উপায় হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এর ফলে তেলের দাম বাড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী দ্রুত মুদ্রাস্ফীতির কারণ হবে।
তবে এটি ইরানের জন্যও একটি চরম আত্মঘাতী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ইরান নিজেও এ পথ ব্যবহার করেই তেল রফতানি করে। তাছাড়া হরমুজ বন্ধ করে দিলে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো- যারা ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের হামলার সমালোচক, তারাও নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এ পদক্ষেপ বিশেষ করে চীনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ ইরানের মোট তেল রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ কিনে থাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ট্রাম্প সমর্থিত ফক্স নিউজে চীনের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, আমি চীন সরকারকে অনুরোধ করছি, তারা যেন ইরানের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে। কারণ তাদেরও তেলের জন্য হরমুজ প্রণালির ওপর বড় মাত্রায় নির্ভরশীলতা আছে।
তিনি আরও বলেন, ইরান যদি হরমুজ বন্ধ করে, সেটি হবে আরেকটি ভয়ানক ভুল। সেটি হবে তাদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যার সামিল।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইতোমধ্যে কিছু সুপারট্যাঙ্কার হরমুজ প্রণালিতে ইউটার্ন নিয়েছে বলে খবরে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
-
ইরান কী বলেছে?
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রেস টিভি জানিয়েছে, ইরানের পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালি বন্ধের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইরানের শীর্ষ নেতাদের ওপরই নির্ভর করছে।
গত ২২ জুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ইরানে ট্রাম্পের বোমা হামলার সিদ্ধান্ত চিরস্থায়ী পরিণতি বয়ে আনবে। তার এ বক্তব্য থেকে প্রতিশোধের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইসরায়েল একটি মারাত্মক ভুল করেছে। তাদের শাস্তি পেতে হবে।তবে হরমুজ প্রণালি নিয়ে তিনি এখনও সরাসরি কিছু বলেননি।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।