Apan Desh | আপন দেশ

ডিজি–আরসি ফুডের যৌথ মিশন, টেন্ডারে ৩০ কোটি টাকার ঘুষ উত্তোলন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ১০ নভেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৪:২০, ১০ নভেম্বর ২০২৫

ডিজি–আরসি ফুডের যৌথ মিশন, টেন্ডারে ৩০ কোটি টাকার ঘুষ উত্তোলন

ফাইল ছবি

খাদ্য অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগকে কেন্দ্র করে এক ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। অভিযোগকারীদের ভাষায়- এটি ছিল ‘একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘুষ মিশন’, যেখানে অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার সমিতির একদল নেতা যৌথভাবে কাজ করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ঘুষের বিনিময়ে বাছাই করা ঠিকাদারদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ আয় নিশ্চিত করা।

সরকারি নথি অনুযায়ী (স্মারক নং: ১৩.০১.০০০০.২০১.৪৯.২৬৫.২৫.২৮৬, তারিখ: ২২/০৯/২০২৫), তালিকাভুক্ত ৮৫৭ জন ঠিকাদারের মধ্যে প্রায় ২৫০–৩০০ জনকে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের বিনিময়ে বাছাই করা হয়েছে। প্রতিজনের কাছ থেকে ৫–৭ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করে মোট প্রায় ৩০ কোটি টাকার এক ‘অফিসিয়াল ব্ল্যাক ফান্ড’ গঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর দরপত্র আহবান করা হলে ৮১৯ জন ঠিকাদার ই-চালানের মাধ্যমে দরপত্র কিনেন। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়া শুরুর পরই শুরু হয় ‘নথি জিম্মি’ পর্ব। কয়েকজন স্বঘোষিত ঠিকাদার সমিতির নেতা আবেদনকারীদের আর্থিক ও কারিগরি নথি নিজেদের হেফাজতে নিয়ে রাখেন- তাদের দাবি ছিল, ‘ভালো দর নির্ধারণের স্বার্থে’ নথি তারা নিজেদের কাছে রাখছেন। কিন্তু জমার দিন সেই নথি আর ফেরত দেয়া হয়নি।

আরও পড়ুন<<>> র‌্যাংগসের পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা, দুদক ম্যানেজ তিন কোটিতে

অভিযোগ অনুযায়ী, ওই নথি জিম্মি করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ঘুষ আদায় শুরু করে। যারা অর্থ দিয়েছে, তাদের নথি প্রক্রিয়ায় রাখা হয়; যারা দেয়নি, তাদের কাগজ ব্লক করে বাদ দেয়া হয়। ভুক্তভোগীরা বলেন- ‘ঘুষ না দিলে দরপত্র জমা দেয়া যায়নি, আর জমা দিলেও পরে ক্রস করে বাদ দেয়া হয়েছে।’

অভিযোগকারীরা আরও জানান, প্রায় ৪৬৭ জন ঠিকাদারের আর্থিক প্রস্তাবে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ক্রস মার্ক’ দিয়ে তা বাতিল করা হয়েছে। অপরদিকে অনুমোদিত ৩০০ জনের বেশি প্রস্তাবে একই কলম, একই হস্তাক্ষর এবং একই লেখনীর প্যাটার্ন পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণ করে যে দর আগে থেকেই তৈরি ছিল- অর্থাৎ নির্বাচন নয়, বরং ঘুষের বাছাই।

গত ২৪ অক্টোবর চিটাগাং রোডের তাজমহল কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত তথাকথিত ‘লটারি সভা’ পুরো প্রক্রিয়াকে এক প্রহসনে পরিণত করে। সেখানে আর্থিক প্রস্তাব ফেরত দেয়ার নামে সকল ঠিকাদারকে ডাকা হয়, কিন্তু উপস্থিতরা দেখেন- ওটা ছিল এক ‘ঘুষের তালিকা প্রকাশ সভা’। অভিযোগকারীদের দাবি, সেদিন অপূর্ণ নথিতে স্বাক্ষর নিতে বাধ্য করা হয়, এবং সেই স্বাক্ষর করা নথিই পরে নির্বাচিতদের তালিকার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যারা আপত্তি তোলেন, তাদের ভয়ভীতি ও অপমান করে সভাস্থল থেকে বের করে দেয়া হয়।

এ অভিযোগের মূল উৎসে রয়েছে এক ‘অননুমোদিত ঠিকাদার সমিতি’, যাদের হাত ধরে পুরো দরপত্র প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয়। অভিযোগকারীরা বলছেন, ‘এ সমিতি খাদ্য অধিদফতরের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার ছায়ায় কাজ করেছে।’ তাদের মতে, অফিসের ছত্রচ্ছায়া ছাড়া এত বড় ঘুষ তোলা সম্ভব নয়।

আবেদনপত্রে সাক্ষরকারী ঠিকাদার মোঃ আলাউদ্দিন (মেসার্স মোঃ আলাউদ্দিন, তালিকাভুক্তি নং-৮১৬) বলেন- ‘তারা আমাদের আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাব নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে এবং ঘুষ ছাড়া ফেরত দেয়নি।’ একই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন মেসার্স সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ (নং-৪৬৮), মেসার্স আমির ব্রাদার্স (নং-৮৫৬) ও মেসার্স জেড এ এন্টারপ্রাইজ (নং-৮৯২)। তাদের ভাষায়, ‘প্রতিজনের কাছ থেকে টাকা নেয়ার হিসাব মিললে বোঝা যাবে প্রায় ৩০ কোটি টাকা কোথায় গেছে।’

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে- ‘তারা বলেছে- উচ্চপর্যায়ের অনুমতি ছাড়া এক টাকাও সরবে না’। আমাদেরকে বারবার বলা হয়েছে, ঘুষ না দিলে দরপত্রে নাম উঠবে না।’

আরও পড়ুন<<>> ন্যাশনাল লাইফের তদন্তে দুদক: ২১শ’ অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন, ৭১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ-পাচার

এ বক্তব্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, অফিস-সমিতি এক যৌথ ‘ডিজি–আরসি নেটওয়ার্ক’ তৈরি করেছে, যেখানে একদল কর্মকর্তা নীরব অনুমোদন দিয়ে মাঠে অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন প্রভাবশালী ঠিকাদার গোষ্ঠীকে।

অভিযোগকারীরা আরও দাবি করেছেন-যাদের নাম নির্বাচিত তালিকায় উঠেছে, তাদের দর একই হস্তাক্ষরে লেখা; আর যাদের বাদ দেয়া হয়েছে, তাদের কাগজে ‘ক্রস মার্ক’। টেন্ডার বক্স খুলে মিলিয়ে দেখলেই এ কারসাজি স্পষ্ট হবে।

অভিযোগে উল্লেখ আছে, প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতেও অনিয়মে অভিযুক্ত ছিলেন- গম আমদানিতে নিম্নমানের পণ্য গ্রহণ, সরকারি জ্বালানি বিক্রির মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন ইত্যাদি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই প্রচলিত। যদিও সেসব এখনো তদন্তাধীন, কিন্তু একই ধরণের কৌশল ও প্রভাব এখানে পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের দাবি- ‘আমাদের নথি উদ্ধার করুন, স্বচ্ছভাবে পুনরায় মূল্যায়ন করুন। ঘুষ দিলে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের দরপত্র বাতিল করে প্রকৃত প্রতিযোগিতার সুযোগ দিন। তদন্তে যদি সত্য বের হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘুষ কেলেঙ্কারির একটি হয়ে যাবে।’

দিায়েরকৃত একাধিক অভিযোগের একটি।- আপন দেশ

অভিযোগের পরও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শুধু মৌখিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা শোনা গেলেও, কে বা কারা তদন্তে আছে তা প্রকাশ করা হয়নি। ঠিকাদারদের আশঙ্কা- ‘যারা ঘুষের চেইনে আছে, তারাই এখন তদন্তের দায়িত্বে।’

খাদ্য অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, অভিযোগের বিস্তৃতি এতটাই বড় যে অনেক কর্মকর্তা এখন চাপে আছেন। কেউ কেউ ফাইল নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছেন, আবার কেউ নিজেকে ‘অজ্ঞ’ দেখাচ্ছেন। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন-‘উপর থেকে চাপ আছে, নামগুলো মুখে আনা যাবে না।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনা শুধু আর্থিক নয়-এটি প্রশাসনিক সুনাম, ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জনআস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। সরকারি প্রকল্পে ঘুষের প্রভাব মানে হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং সরকারি কাজের মানহানি।

অভিযোগকারীরা সতর্ক করেছেন- ‘যদি নিরপেক্ষ তদন্ত না হয়, আমরা আদালতে যাব। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা করব।’ তাদের ভাষায়- ‘এটা শুধু টাকার বিষয় নয়, এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। ঘুষের কারণে প্রকৃত ঠিকাদারদের বাদ দেয়া হয়েছে, আর অযোগ্যরা কাজ পাচ্ছে। এর দায় খাদ্য অধিদফতরকেই নিতে হবে।’

আরও পড়ুন<<>> স্ত্রী-সন্তা‌নসহ সাবেক চিফ হুইপ ফিরোজের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট যে, এ ঘটনার তদন্তে বিলম্ব মানেই প্রমাণ নষ্টের সুযোগ। সরকারের উচিত অভিযোগকারীদের দেয়া দস্তাবেজ, টেন্ডার বক্স, ও আর্থিক প্রস্তাবসমূহ তৎক্ষণাৎ জব্দ করে পুনর্মূল্যায়ন করা। অন্যথায় ‘ডিজি–আরসি ফুড মিশন’—এ নামেই হয়তো আরেকটি সরকারি ঘুষকেলেঙ্কারি ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই- জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রকল্পে যারা ঘুষকে পাসপোর্ট বানায়, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কি সত্যিই দাঁড়াবে? নাকি ঘুষের ছায়া ঢেকে রাখবে প্রশাসনিক নীরবতা? সময়ই এর উত্তর দেবে।

ঠিকাদার সমিতির বক্তব্য

অভিযোগ প্রসঙ্গে এ, হাই এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার সমিতির সভাপতি আব্দুল হাই রাজু এ প্রতিবেদককে বলেন, ২৪ অক্টোবরের ঘটনার কথা আজকে বলছেন কেনো? আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে থাকি আগের মিটিংয়ের কথা এখন মনে থাকে? তবে এখনকার ডিজি ফুড অনেক ভালো মানুষ; তিনি ঘুষ খেলে কোটি কোটি টাকা খেতে পারেন কিন্তু সে ভালো মানুষ। অনেকদিন পর আমরা একটা ভালো মানুষ পেয়েছি।

সমন্বয় কমিটি প্রসঙ্গে আব্দুল হাই রাজু বলেন, ধরনের কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। একই কোড নম্বর প্রসঙ্গে বলেন, আটশ প্লাস ঠিকাদারের মধ্যে হয়তো কিছু ঠিকাদার মিলে একই দর দিতে পারে। তাতে সমস্যা নেই। ক্রসমার্ক ও নথি আটকা প্রসঙ্গে তিনি বলতে রাজি হননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ডিজি ফুড মোঃ আবুল হাছানাত হুমায়ূন কবীরকে ০১৭১১xxxx৪৬৩ নম্বরে একাধিকবার ফোন এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়