
ছবি: আপন দেশ
আর্থিক খাতের অন্যতম আলোচিত প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক পিএলসি আবারও তীব্র আলোচনায়। শরিয়াহ ভিত্তিক পরিচালনার দাবিদার এ ব্যাংক কার্যত এখন দুর্নীতির আস্তানায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের হাতে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে মালিকানা বদল, অন্যদিকে ব্যবস্থাপনায় ঘন ঘন পরিবর্তন এবং দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছ লেনদেন ব্যাংকটি নিয়ে সাধারণ গ্রাহক ও আর্থিক বিশ্লেষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
গত ২২ জুন গভীর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুল মাওলা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতারের এই ঘটনা গোটা ব্যাংক খাতে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর আগেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ একাধিক সংস্থা ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল।
সর্বশেষ ১৪ জুলাই, ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বিএফআইইউ। দেশের সব ব্যাংককে দেয়া এক চিঠিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের হিসাবসংক্রান্ত সব তথ্য—ব্যাংক হিসাব, সঞ্চয়পত্র, লকার, বন্ড, কার্ড, বড় অঙ্কের লেনদেনের ভাউচার—পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ওবায়েদ উল্লাহর উত্থান-পতনের ছায়া
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ একসময় সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তাকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি দাবি করেছিলেন, “যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তা প্রকাশ্যে এনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।” কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে উল্টো। ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাই এখন দুর্নীতির তদন্তের কেন্দ্রে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক লেনদেনে স্বচ্ছতার অভাব, অননুমোদিত ঋণ বিতরণ, গোষ্ঠীগত স্বার্থে ব্যাংকিং সুবিধা দেয়া, ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিশে যাওয়াসহ একাধিক অভিযোগে ডজনের বেশি তদন্ত চলছে।
এস আলমের ছায়া, নতুন গডফাদারের ইশারা
ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের কার্যত নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় গত ৫ আগষ্টের পর—এমন একটি বার্তা প্রচারিত হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক দলের ছায়ানীতিতে চলছে নতুন করে চেয়ার বদলের খেলা। এমডি গ্রেফতার হওয়ার পর ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংকটি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখনই এমডি গ্রেফতার, চেয়ারম্যানের হিসাব তলব—এসব ঘটনা গ্রাহকদের আস্থার সংকটে ফেলবে।”
িআরও পড়ুন<<>> এবার জলিলে ডুবছে ইসলামী ব্যাংক!
আরেকজন কর্মকর্তার মতে, “এ ব্যাংক এখন রাজনীতির গুটির খেলায় আটকা পড়েছে। ইসলামী ব্যাংককে ঘিরে যারা সুবিধা নেয়, তারা চায় না ব্যাংকটি স্থিতিশীল হোক।”
তিনি আরও জানান, চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এখন ‘আতঙ্কিত’, এবং তিনি নিজ ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তা স্বীকারও করেছেন।
গ্রাহকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা
এমডি গ্রেফতার, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত, কর্তৃপক্ষের ফোন রিসিভ না করা—এসব মিলিয়ে ব্যাংকটির স্থিতিশীলতা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। বড় অঙ্কের আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন অনেক গ্রাহক। অনেকে ইতোমধ্যে অর্থ স্থানান্তরের চিন্তা করছেন বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে ফোনে (০১৮৮......৭৭৭) একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তাও পাঠানো হয়েছে, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। একইভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খানও ফোন রিসিভ করেননি।
নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ
বছরের পর বছর ধরে ইসলামী ব্যাংকে দুর্নীতি-অনিয়ম চললেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ছিল নীরব। এমনকি ব্যাংকিং কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক নীতিনির্ধারক এস আলম গ্রুপ বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর চাপের মুখে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের আড়ালে ইসলামী ব্যাংকে যে অনৈতিক আর্থিক অপচালনা হয়েছে, তা তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে গোটা খাতই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আপনর দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।