Apan Desh | আপন দেশ

জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ শহীদ আবু সাঈদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৬ জুলাই ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ শহীদ আবু সাঈদ

ফাইল ছবি

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আবু সাঈদ হত্যার প্রথম বার্ষিকী ১৬ জুলাই। দিনটি ‘জুলাই শহীদ দিবস’ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে দেশের সরকারি আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি বেসরকারি ভবন, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। শহীদদের মাগফিরাতের জন্য দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া এবং অন্যান্য ধর্মীয়প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদদের স্মরণে রংপুরসহ সারা দেশে নানা কর্মসূচি পালন করছে। 

গত বছর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ দিবস। ২০২৪ সালের আজকের এ দিনে আবু সাঈদ পুলিশের অব্যাহত গুলির সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছিলেন। তাকে পুলিশ গুলি করে। এ হত্যার ঘটনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে তীব্রভাবে বেগবান করে। আন্দোলন এতই তীব্র হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

আবু সাঈদের এই বীরত্বগাথার বর্ণনা দিতে গিয়ে সহযোদ্ধারা বলেছেন, পুলিশের গুলির সামনে তার বুক পেতে দেয়ার কারণেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা।

যেভাবে আবু সাইদকে হত্যা করা হয়
কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় সে জুলাই মাসের প্রথম থেকে রংপুরে এটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এর নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আন্দোলন বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ছিল রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

প্রথম দিকে মিছিলে ১৫ জনের মতো উপস্থিতি দেখা গেলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিন রংপুর নগরী থেকে মিছিল আসতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সে মিছিলে আস্তে আস্তে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ক্যাডাররা এ আন্দোলনকে দমন করতে সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। দফায় দফায় হামলা চালায় নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর। পুলিশ তাদের পক্ষ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর মুহুর্মুহু রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড আর গুলি বর্ষণ করে।

১৬ জুলাই সকালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেখানে বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এরপর আড়াই কিলোমিটার দূরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যখন মিছিলটি যাত্রা করে প্রেসক্লাব অতিক্রম করার আগে যোগ দেন সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও সব স্তরের জনতাও।

মিছিলটি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছালে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে থাকে।  

আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী ও জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশও হামলাকারীদের পক্ষ নিয়ে গুলি, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে শতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

এ সময় আবু সাঈদ একাই পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে বুক চেতিয়ে বলতে থাকেন, ‘গুলি করলে কর আমি বুক পেতে দিয়েছি’। এ সময় পুলিশের টার্গেট করা গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। আবু সাঈদের মুখ দিয়ে তখন রক্ত বের হচ্ছিল। সারা শরীরে গুলি আর রাবার বুলেটের ক্ষত। এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সহযোদ্ধারা যা বললেন
জুলাই আন্দোলনের প্রথম থেকেই শহীদ আবু সাঈদের সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সাবেক সমন্বয়ক বেরোবি শিক্ষার্থী শাহারিয়ার সোহাগ। তিনি জানান, জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন তিনি। যেদিন আবু সাইদ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন, সে সময় তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।

তিনি বলেন, বৈষম্যবিরেধী আন্দোলন শুরুতে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোনা ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী ছিলাম। ছোট ছোট মিছিল করি। বেরোবি ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামীম ও তাদের ক্যাডাররা আমাদের নানান হুমকি-ধমকি দিতো মিছিল না করার জন্য। পোমেল বড়ুয়া আবু সাঈদকে ডেকে লাথি-ঘুষি মেরে তাকে শাসিয়েছিল। কিন্তু আবু সাঈদসহ আমরা দমে যাইনি। আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। রংপুর মহানগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়লো। মিছিল দীর্ঘ হতে লাগলো। জুলাইয়ের ৫ তারিখের পর হাজার হাজার শিক্ষার্থী নগরী থেকে মিছিল নিয়ে বেরোবির সামনে আসতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সকল হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে যোগ দিতে শুরু করলেন বিক্ষোভে। নারী শিক্ষার্থীরাও দলে দলে যোগ দিয়েছিলেন।

বেরোবি শিক্ষার্থী জেবিন বলেন, আমি আবু সাঈদের সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম। তার অসীম সাহস আমাকে আন্দোলনে নামতে সাহস জুগিয়েছে। আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করার সময় আমি কয়েক গজ দূরে ছিলাম। সে বার বার পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বলছিল, বুক পেতে দিয়েছি কর গুলি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার যে দুঃসাহস আবু সাঈদ দেখিয়েছে- এটা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তার মৃত্যু শোকেকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে মানুষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেছে। তাই তো আবু সাঈদের আত্মত্যাগ আন্দোলনের প্রধান টার্নিং পয়েন্ট।

বেরোবি শিক্ষার্থী আশফাক, নজরুল, রোমেলসহ অনেকেই জানিয়েছেন, আবু সাঈদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ঘটনাই জুলাই আন্দোলন সফলতার মুখ দেখিয়েছে। তার মৃত্যুকে অনুসরণ করে অনেকেই গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে। আমরা দেখেছি, নিশ্চিত মৃত্যুকে কীভাবে বরণ করেছে আবু সাঈদ।

আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেয়া সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেতা রাজু বাশফোর বলেন, ১৬ জুলাই আন্দোলনে একেবারে আবু সাঈদের কাছাকাছি ছিলাম। তাকে যখন টার্গেট করে গুলি করা হলো মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আমি ও আরও ৩/৪ জন সেখানে যাই। এ সময় পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। এর মধ্যেই আমরা তাকে আহত অবস্থায় প্রথমে রিকশায় পরে একটি অটোতে করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাৎক্ষণিক তাকে ওয়ার্ডে পাঠায়। রোগীর অবস্থা কী জানতে চাইলে কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, সিনিয়র ডাক্তাররা এলে বলবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সিনিয়র একজন ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করে। আবু সাইদের সারা শরীর গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল।

আবু সাঈদ আহত হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান বাসদ মার্কসবাদী রংপুর মহানগর সাধারণ সম্পাদক আরেফিন টিটু। তিনি বলেন, পুলিশের বেপরোয়া গুলি বর্ষণে সে নিহত হয়েছে। পুলিশ টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করেছে। তার লাশ নিয়ে আমরা মিছিল বের করলেও পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

বেরোবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আমরা কয়েকজন সহকর্মী হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি, সে মারা গেছে। পুলিশ তাকে গুলি করেছে হত্যা করার জন্য। এটা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। এরপর আমরা আবু সাঈদের লাশ নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে যাই। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আমি সামনের সারিতে ছিলাম।

শহীদ আবু সাঈদের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে এ প্রতিনিধি গেলে কথা বলেন তার মা মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ, এক বছর হতে চললো। এখনও অনেক খুনি চাকরি করছে। অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না। আমার ছেলেকে হত্যার পর লাশ দাফন করতে বাধা দেয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে দাফন করার চেষ্টা করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন। এদের কোনও শাস্তি ও তাদের গ্রেফতারও করা হলো না।

আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, শুনলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলা আমলে নিয়ে ২৬ জনের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু এক বছরেও তো মামলার কোনও অগ্রগতি নেই। সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমার এখনও শঙ্কা। আমি ন্যায় বিচার চাই।

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার ন্যায্য ও সুষ্ঠু বিচার চাই। সে সঙ্গে কোন নিরপরাধ মানুষ যাতে সাজা না পায় সেটাও দেখতে হবে।

বেরোবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে শহীদ আবু সাঈদের হত্যাকারী, ইন্ধনদাতা, অর্থের জোগানদাতাসহ সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

এদিকে শহীদ আবু সাঈদ দিবস উপলক্ষে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনব্যাপী নানান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কবর জিয়ারত, র‌্যালি, আলোচনা সভাসহ নানান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আবু সাঈদের পরিবারের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী মিলাদ, দোয়া মাহফিল, দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ, আলোচনাসহ নানান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

আপন দেশ/জেডআই

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়