
ফাইল ছবি
রাতের ভালো ঘুম নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মতোই জরুরি। রাতের ঘুমটা ভালো না হলে তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব শরীরেও পড়ে। কাজে মন না বসা, মাথাব্যথা, মুড সুইং ও ভাবনার সক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি শরীরে মেদ জমা, সহজে ওজন না কমা, ডায়াবেটিসসহ আরও নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই রাতে ভালো ঘুমানোর জন্য এ উপায়গুলো মেনে চলতে পারেন।
দিনের আলো উপভোগ
রাতের ঘুম ভালো করার জন্য প্রথমেই আমাদের দেহের ‘সারকাডিয়ান রিদম’–এর ব্যাপারে জানতে হবে। এটি হচ্ছে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি, যা প্রতিদিন ঘুম ও জেগে থাকার শিডিউল ঠিক করে। দেহের এই ছন্দ ঠিক রাখতে পারলে রাতের ঘুম হবে প্রশান্তির। সারকাডিয়ান রিদমের অনেকগুলা প্রভাবক রয়েছে। দিনের আলো তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন বেশ খানিকটা সময় আমাদের দিনের আলোয় কাটানো উচিত। এতে যেমন দিনের বেলায় কাজ করার শক্তি পাওয়া যায়, আবার দেহের অভ্যন্তরীণ ছন্দের সঙ্গেও ঘুমের সমন্বয় হয়। দিনের আলো গায়ে না লাগানো গেলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ঘরে বা অফিসে বেশি কৃত্রিম লাইটের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময় থাকা।
নীল আলোর ব্যবহার কমানো
দিনের আলো যেমন আমাদের সতেজ ও প্রাণবন্ত করে, সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত আলো তেমনি আমাদের ঘুমের ক্ষতি করে। সন্ধ্যার পরও অতিরিক্ত আলোয় থাকলে ঘুমের জন্য দরকারি ‘মেলাটোনিন’ নামক হরমোনের মাত্রা শরীরে কমে যায়। ফলে রাতে সময়মতো ঘুম আসে না।
অনেক সময় দেখা যায়, ঘরের আলো বন্ধ থাকলেও আমরা কোনো না কোনো ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আর এসব ডিভাইসের নীল আলো রাতে ঘুম না আসার কারণ হতে পারে। ডিভাইসের নীল আলো আমাদের মস্তিষ্ককে জানান দেয়, আমরা এখনো দিনের আলোয় আছি। তাই সহজে ঘুমের ভাব আসে না। মস্তিষ্ককে ঘুমের সময় জানান দেওয়ার জন্য ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে এসব ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
ক্যাফেইন গ্রহণ
গবেষণায় দেখা যায়, সন্ধ্যায় চা–কফি পানের কারণে রাতে পুরো ঘুমের প্রায় ৪৫ মিনিট (৭ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যাফেইন সাধারণত আমাদের কাজের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে ও শরীরে ফুরফুরে ভাব আনতে সাহায্য করে। তাই রাতে ঘুমের সমস্যা হলে বিকেল বা সন্ধ্যার পর চা–কফি পান না করাই ভালো। তবে অভ্যাসের কারণে যদি বিকেলের পর চা–কফি পানে ইচ্ছা করে, সে ক্ষেত্রে ডি–ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করতে পারেন।
দিনের বেলায় ঘুম
দিনের বেলা কাজের অবসরে ছোট একটা ভাতঘুম অনেকের প্রিয়। তবে রাতের ঘুমের অভাব পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দিনের বেলা লম্বা সময় ঘুমানো ঠিক নয়। কেননা, এটা ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হতে পারে। তা ছাড়া দেহ তার অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতিতেও তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণত যাঁরা অনেক বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন, তাঁরা দিনে অল্প সময় ঘুমিয়েও রাতে ভালো ঘুমাতে পারেন। তবে আজকালকার ডেস্কটপ অফিসের বেলায় এমন রীতি খাটে না। তাই দিনে ঘুমানোর অভ্যাস বাদ দিতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ওঠা
আমাদের শরীরের একটা নির্দিষ্ট ছন্দ রয়েছে। এ ছন্দ অনুযায়ী শরীর নিজেকে ঘুমের জন্য তৈরি করে আবার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। এই লুপ মেনে চলতে পারলে নির্দিষ্ট সময়ে আপনার ঘুম চলে আসবেই। আর সকালে উঠতেও অ্যালার্ম লাগবে না। রাতে যদি ভালো ঘুম না হয়, তবুও কয়েক দিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুয়ে পড়ুন এবং নির্দিষ্ট সময়েই সকালে ওঠার চেষ্টা করুন। কয়েক সপ্তাহ পরে খেয়াল করে দেখবেন, শোয়ামাত্রই ঘুম চলে আসছে।
আরামদায়ক বিছানা
ভালো ঘুমের জন্য আরামদায়ক বিছানা খুব জরুরি। বিছানার তোশক বা ম্যাট্রেস, বালিশ, কোলবালিশ, চাদর, কমফোর্টার–জাতীয় উপকরণ ভালো মানের ও আরামদায়ক হওয়া দরকার। মানুষভেদে একেক জনের পছন্দ একেক রকমও হতে পারে। যেমন তরুণ বয়সীরা লিনেন–জাতীয় ফেব্রিকে ভালো ঘুমাতে পারেন। অন্যদিকে বেশির ভাগ বয়স্কদের ভালো ঘুমের জন্য পছন্দ মোটা সুতি–জাতীয় ফেব্রিক। তা ছাড়া সপ্তাহে কমপক্ষে একবার হলেও বিছানার চাদর পরিষ্কার করা উচিত। আর কয়েক বছর পেরিয়ে গেলে তোশক বা ম্যাট্রেসের বেডিং পরিবর্তন আবশ্যক।
শোবার ঘরের পরিবেশ
শুধু আরামদায়ক বিছানা হলেই যে রাতে ভালো ঘুম আসবে, তা নয়। শোবার ঘরে ঘুমের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা খুব দরকার। শোবার ঘরের তাপমাত্রা কেমন, বায়ু চলাচল, অতিরিক্ত শব্দ আসে কি না, ঘরের বাতাসে অক্সিজেন বা কার্বন ডাই–অক্সাইডের লেভেল—এ সবকিছুই ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। ঘুমের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য সন্ধ্যার পরপর ঘরের অতিরিক্ত আলো, শব্দ বা ডিভাইসের ব্যবহার কমাতে হবে। যদি সম্ভব হয়, শোবার ঘরের তাপমাত্রা নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী সেট করে নিন। শহরাঞ্চলের বায়ুর অতিরিক্ত দূষণ থেকে বাঁচতে ঘরের বায়ুর গুণগতমান বৃদ্ধিতেও নজর দিন।
খাবারদাবার
রাতে দেরি করে খাওয়াদাওয়া ঘুমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ঘুমানোর বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই খাওয়ার কাজ সেরে ফেলতে হবে। অনেকেই সন্ধ্যাবেলা রাতের খাবার সেরে ফেলেন। কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবার নাশতা–জাতীয় কিছু না কিছু খান। সেই নাশতা বা রাতের খাবারে যদি অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট থাকে, তবে তা রাতের ভালো ঘুমকে ব্যাহত করে। তা ছাড়া পানি বা পানীয় জাতীয় খাবারও ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকে পরিহার করা উচিত। নয়তো অসময়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙে যাবে।
মানসিক প্রস্তুতি ও শরীরচর্চা
ভালো ঘুমের জন্য সন্ধ্যা থেকেই একটা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। শারীরিক ও মানসিকভাবে রিলাক্স হওয়ার উপায়গুলো নিয়মিত চর্চা করার মাধ্যমে রাতের ঘুমটা ভালো হয়। ঘুমের সমস্যা দূর করার জন্য মেডিটেশন, শ্বাসের চর্চা, বই পড়া, মৃদু ছন্দের গান শোনা ইত্যাদি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
নিয়মিত শরীরচর্চা বা ব্যায়াম শুধু বাহ্যিক শারীরিক গঠনের জন্য নয়; বরং রাতের ভালো ঘুমের জন্যও উপকারী। তবে বেশি রাতে ব্যায়াম করলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শরীরে তখন কর্মচাঞ্চল্যের সহায়ক হরমোন অ্যাড্রেনালিন ও এপিনেফ্রিন বেশি থাকায় ঘুম আসতে চায় না। তাই ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগেই ব্যায়াম সেরে ফেলতে হবে। এরপর শরীরে ক্লান্তিভাব এলে ঘুমও ভালো আসবে।
স্লিপিং ডিজঅর্ডার
আজকাল অনেক মানুষই স্লিপিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। স্লিপ অ্যাপনিয়া, ইনসমনিয়া, প্যারাসমনিয়া, নারকোলেপসি ও রেস্টলেস লেগস সিনড্রোমের মতো সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁদের রাতে ঘুমাতে খুবই অসুবিধা হয়। প্রাথমিকভাবে অনেকেই মেলাটোনিন নামক ঘুমের হরমোনের জন্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন। এ ছাড়া অনেকের কাছেই ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, ওমেগা–৩ ও রেসভেরাট্রল সাপ্লিমেন্ট ঘুমের জন্য কার্যকরী। তবে এসব সাপ্লিমেন্ট হুট করে ঘুম নিয়ে আসার কোনো জাদুকরি উপাদান নয়। এসব হয়তো কিছু কলাকৌশলে সহায়তা করে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার শারীরিক অবস্থা বুঝেই সাপ্লিমেন্ট নেবেন। সূত্র: হেলথ লাইন
আপন দেশ/এমবি