
ছবি: আপন দেশ
বাংলাদেশে বিচারপ্রক্রিয়া কতটা ধীর, কতটা প্রভাবাধীন—তার নগ্ন উদাহরণ সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড ও মুনিয়ার রহস্য মৃত্যু। দুই ঘটনাই একসময় জাতীয় আলোচনায় ছিল, কিন্তু আজ তদন্ত থেমে আছে, বিচার ঝুলে আছে। রাষ্ট্র নির্বিকার, আর সমাজ কেবল স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত। প্রশ্ন উঠছে—আইনের শাসন কি আসলেই সকলের জন্য সমান? নাকি পুঁজি ও প্রভাবের কাছে ন্যায়বিচার জিম্মি?
১৩ বছরেও অচল মামলা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহরুন রুনী। তাদের শিশুপুত্র তখন একই ঘরে ছিল। তদন্তের দায়িত্ব প্রথমে থানার, পরে ডিবি, পরে হাইকোর্টের নির্দেশে র্যাবের হাতে যায়। এরপর কেটে গেছে ১৩ বছর। এ সময়ে র্যাব ১১৯ বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় চেয়েছে। কিন্তু আজও আদালতে কোনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন নেই। এ জোড়া হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বরাবরের মতো আগামী ১১ আগস্ট দিন ধার্য করেছে আদালত।
প্রাথমিকভাবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি ধরা পড়বে।’ কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। এমনকি কোনো আসামির নামও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এলেও, তদন্তে তাদের উপস্থিতি অনুপস্থিত। সেই সাহারা খাতুন বেঁচে নেই। তবে তার পর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হাতবদল হয়েছে একাধিকবার।
মুনিয়ার মৃত্যু ও তদন্তের স্থবিরতা
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল, গুলশানের একটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিশোরী মুনিয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়। তার হাতে লেখা ডায়েরি ও চিঠিতে প্রেম-ঘটিত সম্পর্ক ও মানসিক নির্যাতনের ইঙ্গিত ছিল। জানা যায়, তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার ও একটি প্রভাবশালী মিডিয়া হাউসের এমডি সায়েম সোবহানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
মৃত্যুর পর তার বোন আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেন। মামলার প্রধান অভিযুক্ত তদন্ত শুরুর আগেই দেশ ছাড়েন। তদন্ত প্রক্রিয়ায় ধীরতা দেখা দেয়, তদন্তকারী কর্মকর্তার বদলি হয় এবং শেষ পর্যন্ত চার্জশিট থেকে অভিযুক্তের নাম বাদ পড়ে। এমনকি চিঠি, বার্তা, অর্থ লেনদেনসহ একাধিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মামলাটি কার্যত স্থগিত অবস্থায় পড়ে থাকে। তৎকালীন সরকারের কর্তাদের ছায়ায় দেশে ফিরেন সেই আসামিরা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। পেয়েছেন পুলিশি পাহারাও। ফের ৫ আগস্টের পর বিদেশের বাড়িতে গেছেন মামলার আসামিরা। কেউ কেউ আছেন দেশেই।
পুঁজির প্রভাব, তদন্তে প্রশ্ন, ন্যায়বিচারে আস্থা কমছে
দুটি মামলাই এখন এক ধরনের 'ঝুলে থাকা' অবস্থায় রয়েছে। এসব ঘটনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নীরবতা, অস্পষ্টতা এবং তদন্তের অগ্রগতিহীনতা জনমনে প্রশ্ন তুলেছে: বিচার কি প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে আলাদা? তদন্তের গতি কি অর্থ ও ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে থেমে যায়?
একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি বহুবার উঠেছে। কিন্তু এ দাবির বিপরীতে যে প্রতিক্রিয়া এসেছে তা প্রায়শই সময়ক্ষেপণ, তদন্ত কর্মকর্তার বদলি, অথবা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে আদালতে সময় চাওয়ার আবেদন।
সায়েম সোবহান একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তিনি দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, মালিকানাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেই জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তাকে কখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। মুনিয়া ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় করা মামলা প্রত্যাহার করতে ১শ’ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন প্রধান অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেন নিহতের বড়বোন নুসরাত জাহান তানিয়া।
সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যার ক্ষেত্রেও মিডিয়ার ভেতরে থাকা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম বিভিন্ন সময় গুঞ্জনে এলেও তারা আজও তদন্তের বাইরে।
আরও পড়ুন<<>> ‘মুনিয়ার সুরতহাল-ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ডাবল মার্ডারের ভয়ংকর তথ্য’
এ প্রেক্ষাপটে জনমনে তৈরি হয়েছে গভীর অসন্তোষ—দেশে কি সত্যিই ‘সব নাগরিকের জন্য সমান আইন’ চালু আছে? নাকি বিচার এখন ধনিক শ্রেণির হাতে নিয়ন্ত্রিত?
মিডিয়ার ভূমিকা ও আত্মসমালোচনার সময়
সাগর-রুনী ছিলেন সাংবাদিক। মুনিয়া ছিলেন একজন সম্ভাবনাময় তরুণী, যে একটি বিতর্কিত সম্পর্কের বলি হয়েছেন। এ দুটি ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ায় সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক সময় যারা ‘জাস্টিস ফর সাগর-রুনী’ ব্যানার নিয়ে রাজপথে ছিলেন, আজ অনেকেই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে অনিচ্ছুক।
মিডিয়ার দায়িত্ব হলো সত্য তুলে ধরা—সেটি যত অস্বস্তিকরই হোক। সাংবাদিকতা নিরপেক্ষ, সত্যনিষ্ঠ ও প্রশ্নমুখর না হলে সে সমাজের আয়না হয়ে উঠতে পারে না। এ নীরবতা সমাজে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সরকারি নীরবতা ও জবাবদিহির অভাব
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলছে। কিন্তু এ দুটি আলোচিত মামলার বিষয়ে তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এটা কি ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা, নাকি রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা? একটি দায়িত্বশীল সরকার নাগরিকের ন্যায়বিচারের প্রশ্নে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন<<>> বসুন্ধরার পাচারের টাকায় তিন মহাদেশে আট সাম্রাজ্য!
সরকারের উচিত মামলাগুলোর তদন্ত অগ্রগতি বিষয়ে জনসমক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করা, প্রভাবশালীদের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তদন্তকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা।
যদি একজন সাংবাদিক, কিংবা একজন কিশোরী নারীও ন্যায়বিচার না পায়, তাহলে সাধারণ নাগরিক কী আশা করবে? রাষ্ট্র তখনই ব্যর্থ হয়, যখন সে অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি না করে নিজেই নীরবতার আশ্রয় নেয়। মুনিয়া ও সাগর-রুনীর মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—তারা হয়ে উঠেছে একটি বিচারহীন রাষ্ট্রের প্রতীক।
এ রাষ্ট্র কি একদিন সাহস করে বলবে-আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম, কিন্তু এখনো সংশোধনের সময় আছে? নাকি চিরকালই ন্যায়বিচার থাকবে শোক ও স্মৃতির পাতায়?
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।