Apan Desh | আপন দেশ

পলাতক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে উদাসীন রুয়েট প্রশাসন

রাবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

পলাতক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে উদাসীন রুয়েট প্রশাসন

ফাইল ছবি

বিধি অনুসারে রাজনীতি করার সুযোগ নেই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তবে গেল ১৫ বছরে রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন মিছিল, মিটিং ও সভা-সমাবেশে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেখা গেছে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভয়ভীতি দেখানো এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় ৫ আগস্টের পর নয়জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও রুয়েট প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রুয়েটের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাহনেওয়াজ সরকার সেডু, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশীদ, প্রকৌশল শাখার সহকারী প্রকৌশলী নায়েম রহমান নিবিড়, পুরকৌশল শাখার জুনিয়র সেকশন অফিসার আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু, শিক্ষা শাখার প্রোগ্রামার একেএম আনোয়ারুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডাটা প্রসেসর মো. মহিদুল ইসলাম, শহীদ লেফটেন্টে সেলিম হলের হিসাব সহকারী মো. সুজন ইসলাম ও গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক্স বিভাগের ডাটা প্রসেসর আব্দুল্লাহ আল মামুন শুভ-এর নামে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানোর অভিযোগে রাজশাহী মহানগর ও জেলার কয়েকটি থানা পৃথকভাবে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়াও রুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফাহমিদ লতিফ লিওন ও সাধারণ সম্পাদক সৌমিক শাহার নামের বোয়ালিয়া থানায় মামলার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

রুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, বোমা ও পাথর নিক্ষেপে জড়িতদের এখনো কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি; বরং তারা স্বপদে বহাল রয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছেন কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা। এসব দোষীদের গোপনে সহযোগিতা করে নিরাপদে রাখার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

তবে রুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আরিফ আহম্মেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আটজন কর্মকর্তা অফিসে অনুপস্থিত। উপাচার্যের নির্দেশে তাদের বেতন-ভাতা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ মেডিকেল লিভের আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি।

রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ফৌজদারি মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে রুয়েটের কাছে কোনো তথ্য নেই। রুয়েটে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তাছাড়া আরএমপি থেকে এ বিষয়ে কোনো চিঠি না পাওয়ায় আমাদের কাছে কোনো প্রকার তথ্য নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুয়েটের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিদ্ধার্থ শঙ্কর সাহা ২০১৫-২০২০ মেয়াদে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন, তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে পদ হারান তিনি। বর্তমানে তিনি মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি, হুমকি ও ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা তাকে রুয়েট ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এছাড়া, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের ভাই শাহনেওয়াজ সরকার সেডু রুয়েটের কর্মকর্তা হলেও ২২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। তার বিরুদ্ধে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা এবং কর্মস্থলে অশোভন আচরণের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক। 

পুরকৌশল শাখার জুনিয়র সেকশন অফিসার আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু রাজনৈতিক তদবিরে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে বেতন নিতেন। বিষয়টি প্রকাশিত হলে রুয়েট প্রশাসন তাকে শোকজ করে এবং বেতন-ভাতা স্থগিত করে। তিনি ৫ আগস্টের আগেই সাময়িক বরখাস্ত হন।

৫ আগস্টের পর কয়েকদিন অফিস করেছিলেন রুয়েটের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশীদ হারুন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাকে অফিসে খোঁজাখুঁজি করলে সুকৌশলে রুয়েট ত্যাগ করেন। এরপর থেকে তিনিও পলাতক।

রুয়েট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রাজনৈতিক তদবিরে রুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক আহবায়ক হারুন সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পান। এরপর তিনি নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করেন এবং তার মাধ্যমেই সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতা রুয়েটে চাকরি পান। তাদের মধ্যে অনেকে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে হামলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

২০২৪ সালের ১০ আগস্ট রুয়েট প্রশাসন একটি অফিস আদেশ জারি করে ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। আদেশে বলা হয়, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের শাস্তি দেয়া হবে। তবে আদেশ সত্বেও রুয়েটে রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত ছিল এবং প্রশাসন ছিল উদাসীন। গেল ডিসেম্বর সাধারণ শিক্ষার্থীরা রুয়েটে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধ এবং জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনে জড়িত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানায়।

রুয়েটের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গত ১৬ বছর ধরে রুয়েটের প্রায় অর্ধশত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রুয়েট বিধি উপেক্ষা করে রাজশাহীর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাদের সবাই আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এবং তারা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের নির্যাতনে জড়িত। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে, তবুও রুয়েট প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। 

সিভিল ডিপার্টমেন্টের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আবু রায়হান বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, বোমা ও পাথর নিক্ষেপে জড়িতরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা দিব্যি অফিস করছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কিছু শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের চাপ ও হয়রানি করছেন। আমরা জানতে পেরেছি, এরা গোপনে তাদের স্বপদে বহাল রাখতে সর্বাত্মক সহায়তা করছে।

শিক্ষার্থীরা রাবির উদাহরণ টেনে বলেন, রাবি প্রশাসন ছাত্রলীগের ৩৩ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, তাদের সনদ বাতিল এবং ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু রুয়েট প্রশাসন এসব বিষয়ে আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো উপেক্ষা করছে।

রুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যারা জুলাই আগস্টের বিপ্লবকে প্রতিহত করার কাজে লিপ্ত ছিল এবং যারা অফিসে আসছে না; পলাতক আছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। অনেকের বেতন-ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। এ নিয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছি। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

ছাত্রদের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, মাত্র দুমাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। তারপরও এর মাঝেই অনেক কাজ-ই সম্পন্ন করেছি। দৃশ্যমান কাজ দেখাতে হলে আমাকে কিছুটা সময় দিতে হবে। তদন্ত হবে, যাচাই হবে; তবেই ভালো ফলাফল মিলবে। আর ছাত্রদের যেকোনো প্রয়োজন হলে আমাকে জানাতে হবে। আমাকে না জানালে আমি তা কীভাবে জানব?

আপন দেশ/এসএমএস

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

Advertisement

জনপ্রিয়