
সংগৃহীত ছবি
জুলাই আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতিরাতে কোর কমিটির বৈঠক হতো। কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তাদেরকে তুলে আনার প্রস্তাবটি ডিজিএফআইয়ের ছিলো বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষ্য দিয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
তিনি বলেন, কোর কমিটির এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই ও সাবেক ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে তাদের আটক করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
এছাড়াও জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দু’টি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। একটির নেতৃত্ব দিতেন হাবিব ও আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মনির। জবানবন্দিতে এমনই তথ্য তুলে ধরেছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
মঙ্গলবার (০২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তিনি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এ জবানবন্দি দেন চৌধুরী মামুন।
ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দিতে মামুন বলেন, আমি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে ১৯৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর যোগদান করি। বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশের দায়িত্ব পালনের পর ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাকে দুইবার চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আমি মোট ২২ মাস আইজিপি’র দায়িত্ব পালন করি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতি করিনি। তবে আমার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমার বাবা সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার সুনাম এবং সরকারের প্রতি আমার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশের ডিআইজি, সিআইডি-এর প্রধানসহ র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করে। পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীতে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দেয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমার সততা, দক্ষতা বিবেচনাক্রমে আইজিপি হিসেবে আমাকে নিয়োগ প্রদান করেন। পুলিশ বাহিনীর সুনাম এবং অফিসারদের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব যাতে দেখা না দেয়, সেজন্য আমাকে পরবর্তীতে দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।
আরও পড়ুন>>>রাজধানীতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক বিভিন্ন বলয় তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিষয় এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েন। সিনিয়র অফিসার হিসাবে আমার মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের বাহিনীকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত ছিল। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় বিতর্কিত পুলিশ অফিসাররা স্বাভাবিক আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাপক তৎপর ছিল।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী রাতের বেলায় ব্যালট বক্সে প্রায় ৫০ শতাংশ -এর মতো ভোট রাখার পরামর্শ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া হয় বলে শুনেছি। মাঠ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে রাতে ব্যালট বক্সে ভোট দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রেরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা ও উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, এসপি ও থানার ওসিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় পুলিশ অফিসারদেরকে বিবেচনা করা হতো। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে পেশাদারিত্ব দেখানো হয়নি।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের পর পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কিছু পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী পুলিশ অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি পান। এসব অফিসারদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারাও তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতের বেলা নিয়মিত বৈঠক হতো, যা গভীর রাত পর্যন্ত চলতো। মন্ত্রীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিলো ডিএমপি কমিশনার হাবিব, ডিবি’র হারুন অর রশীদ, এসবি’র মনিরুল ইসলাম, ডিআইজি’র নুরুল ইসলাম, বিপ্লব কুমার, এডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজাহার, ওসি ফরমান, ওসি অপূর্ব হাসানসহ আরো বেশ কিছু অফিসারের। এরা কেউই আমি বা আইজিপি’র নির্দেশ সঠিকভাবে মানতেন না। তারা মনে করতেন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীসহ সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের কারো কারো ভালো সম্পর্ক ছিলো। আইজিপি হিসেবে আমি চাইতাম-পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক।
তিনি বলেন, পুলিশে গোপালগঞ্জ জেলার অবস্থান বেশ শক্ত। অফিসার ও ওসি পর্যায়ে গোপালগঞ্জ জেলার প্রাধান্য ছিলো। তারা সাধারণত কমান্ড মানতেন না ও নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতেন। এদের বিষয় সাধারণত দেখতেন তৎকালীন আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। ঢাকার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ অফিসার ছিলেন। পুলিশের মধ্যে অ্যাডিশনাল আইজিপি, তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ও কমিশনার হাবিবের মধ্যে সখ্য ছিলো। তারা আলাদাভাবে তাদের লোকজন ও সমমনা পুলিশ অফিসারদের মেইনটেন্স করতেন। পুলিশ বাহিনীর ইমেজ রক্ষায় ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমাকে আইজিপি হিসেবে পরবর্তীতে দুইবার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা হয়।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় আমি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। র্যাবের মহাপরিচালক থাকার কারণে আমি জানি যে, টিএফআই সেল র্যাবের সদর দফতরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান হলো উত্তরার র্যাব-১ এর কম্পাউন্ডের ভেতরে। এছাড়াও র্যাবের ইউনিটগুলোর অধীনেও আলাদা আলাদা সেল/বন্দিশালা ছিলো। যেগুলো সংশ্লিষ্ট র্যাব ইউনিটগুলোর কমান্ডারদের অধীনে পরিচালিত হতো। র্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্নমত মতাবলম্বী ও সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র্যাবের ভেতরে একটা কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এ কাজগুলো প্রধানত র্যাব (অপারেশন্স) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন।
তিনি আরও বলেন, র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এই ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদ্বেষ্টা তারিক সিদ্দিকির পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি। র্যাব যদিও পুলিশের আইজি’র অধীনে ছিলো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না ও র্যাবের প্রধানরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে কাজ করতো।
জুলাই আন্দোলন প্রসঙ্গে সাবেক এ আইজিপি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতেই নিয়মিত কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব রাজনৈতিক টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, র্যাবের ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিবি’র ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকি, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক, এনটিএমসি’র ডিজি মেজার জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো।
তিনি বলেন, কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে আটক করার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয় ও সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়। কোর কমিটির মিটিংয়ে তাদেরকে আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে তাদেরকে আটক করা হয়। ডিবি প্রধান হারুনের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিলো। আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে জিন নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।