সংগৃহীত ছবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ভেনিজুয়েলা ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলেছে। ট্রাম্প এখন মাদকবাহী নৌকাগুলোতে আক্রমণ বাড়াতে চেয়েছেন। তিনি সম্ভাব্য স্থল অভিযানের কথাও বলেছেন। এর ফলে, দুটি দেশ এখন মুখোমুখি সংঘাতের আশঙ্কায় রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে আলোচনা করে গাজা বা ইউক্রেন সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভেনিজুয়েলার প্রতি তাদের মনোভাব একেবারে আলাদা। অন্যান্য দেশে যুদ্ধ শেষ করার ইচ্ছা দেখালেও, ট্রাম্প মাদুরোর সমাজতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সরাসরি আহবান জানিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি মাদুরো ও তার সরকারের প্রধানদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। তারা বলেছে, এ নেতারা 'কার্টেল দে লস সোলস' নামে একটি মাদক চক্রের সদস্য। হোয়াইট হাউস এ চক্রটিকে 'বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন' বলে উল্লেখ করেছে। তবে, কারাকাস (ভেনিজুয়েলার রাজধানী) এ অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। 'কার্টেল দে লস সোলস'-এর অস্তিত্ব নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছিলেন, ভেনিজুয়েলার আকাশসীমাকে 'বন্ধ' বলে ধরে নেয়া উচিত। খুব শীঘ্রই একটি স্থল অভিযান শুরু হবে। ট্রাম্প এখনো তার এ হুমকি থেকে সরেননি। যদিও ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, ট্রাম্প সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
আরও পড়ুন>>>ইউক্রেনকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি
ভেনিজুয়েলায় আমেরিকা সত্যিই স্থল অভিযান শুরু করবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন।
বোগোটার লা স্যালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লোরেনা ইরাজো প্যাটিনো সামরিক অভিযানের ইতিহাস টেনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, পানামা বা আফগানিস্তানের মতো অভিযান এখানে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর কারণ হলো, ভেনিজুয়েলার ভূখণ্ড অনেক বিশাল।
এছাড়াও, এমন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য কলম্বিয়ার সামরিক সহায়তা দরকার। কিন্তু ভেনিজুয়েলার প্রতিবেশী কলম্বিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন তিক্ত। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো একজন সমাজতান্ত্রিক নেতা। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি তাকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রেখেছে। তাই প্যাটিনো মনে করেন, কলম্বিয়ার সমর্থন আমেরিকা পাবে না।
অধ্যাপক প্যাটিনো মনে করেন, আমেরিকা সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নরম্যান্ডি-স্টাইলের (একসঙ্গে বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ) বড় অভিযান শুরু করবে না। বরং তারা তাদের নৌ-পাহারা আরও কঠোর করবে। বিতর্কিত মাদক-বিরোধী অভিযান আরও স্থানীয়ভাবে বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, এটি কোনো আঞ্চলিক আক্রমণ নয়, বরং আক্রমণাত্মক নিয়ন্ত্রণের কৌশল।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে, আমেরিকা ক্যারিবিয়ান সাগরে তাদের নৌ-সামরিক যানের উপস্থিতি অনেক বাড়িয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড-কে এ অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও, ভেনিজুয়েলার উপকূলের কাছ দিয়ে বি-৫২ বোমারু বিমান উড়তে দেখা যাচ্ছে।
আমেরিকা ১৮২৩ সালের মনরো ডকট্রিন-এর সময় থেকে লাতিন আমেরিকাকে তাদের 'নিজের উঠোন' হিসেবে দেখে আসছে। তাই তারা এ অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সময়ে নতুন করে সামরিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখন বিশ্ব আমেরিকার একমেরু ব্যবস্থা থেকে বহু-মেরু বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আলফোনসো ইনসুয়াস্টি রদ্রিগেজ, যিনি জিআইডিপিএডি গবেষণা দলের পরিচালক, ভেনিজুয়েলায় সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এ মুহূর্তে আক্রমণ একটি কৌশলগত আত্মহত্যা হবে। তার মতে, আক্রমণ হলে পুরো মহাদেশটি ভেঙে যাবে ও একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত শুরু হবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
আমেরিকার কিউবা আক্রমণের এক বিপর্যয়কর স্মৃতি রয়েছে, যা ১৯৬১ সালে ঘটেছিল। সে অভিযানের নাম ছিল 'বে অফ পিগস'। এর লক্ষ্য ছিল কিউবার কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। সে কিউবা এখন মাদুরো সরকারের একজন শক্তিশালী সমর্থক। অতীতে এমন মার্কিন হস্তক্ষেপের কারণে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই তাদের অঞ্চলে আমেরিকার উপস্থিতি পছন্দ করে না।
রদ্রিগেজ মনে করেন, ট্রাম্পের এ হুমকি মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এটি ভেনিজুয়েলায় একটি আসন্ন আক্রমণের লক্ষণ নয়। তিনি বলেন, ট্রাম্প ভয়, বিভাজন এবং অভ্যন্তরীণ ভাঙনের বীজ বপন করার চেষ্টা করছেন। এর লক্ষ্য হলো দেশটির সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করা ও নতুন নিষেধাজ্ঞাকে প্রমাণ করা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের মাদুরো-বিরোধী এবং মাদক পাচার-বিরোধী অভিযানের পেছনে একটি মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। এর লক্ষ্য হলো রক্ষণশীল ও হিস্পানিক উভয় ভোটারকে একত্রিত করা। ফ্লোরিডার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচনে সফল হওয়ার জন্য এটি খুব জরুরি।
রদ্রিগেজ বলেছেন, 'মাদক সন্ত্রাসবাদ'-এর আলোচনাটি হলো ইরাকের 'গণবিধ্বংসী কাল্পনিক অস্ত্রের' মতো একটি অজুহাত। এর মাধ্যমে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি নৈতিক বৈধতা তৈরি করা হয়।
মাদুরো ২০১৩ সালে ভেনিজুয়েলার নেতা হওয়ার পর থেকেই অনেক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তিনি রাশিয়া, চীন ও ইরানের মতো আমেরিকার অন্যান্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। নির্বাচনি জালিয়াতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, মাদুরো ভেনিজুয়েলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সমর্থন পান।
ভেনিজুয়েলায় আমেরিকার প্রচলিত যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা কম। তাই দেশটি ভিয়েতনাম বা কিউবার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে 'দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয় যুদ্ধ' নামে একটি সামরিক নীতি গ্রহণ করেছে।
অধ্যাপক প্যাটিনো বলেছেন, যুদ্ধ শুরু হলে বিশেষ সামরিক ইউনিটের কমান্ডাররা কঠিন ভূখণ্ডে (যেমন সীমান্ত জঙ্গল বা ঘন জনবসতিপূর্ণ কারাকাসের মতো শহর) পিছু হটবে। তারা বেসামরিক মানুষের সঙ্গে মিশে যাবে। এটি একটি অসম অভিযানের শুরু হবে।
তিনি মনে করেন, এর ফলাফল হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং বিকেন্দ্রীভূত প্রতিরোধ। এতে দেশ পরিচালনা কঠিন হয়ে উঠবে। সবচেয়ে দুঃখজনক পরিস্থিতি হবে, বেসামরিক লোকেরা সংঘর্ষে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিরিয়ার সংকটের মতো নতুন করে গণ-স্থানচ্যুতির ঘটনা ঘটতে পারে।
মাদুরো সরকার মিলিশিয়া থেকে শুরু করে সকল আঞ্চলিক নেটওয়ার্ককে একত্রিত করবে। বিশেষ করে মার্কিন-বিরোধী শক্তিগুলোকে ব্যবহার করবে। তারা অসম যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করবে, পাশাপাশি জনসমাবেশ ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































