
প্রকৌশলী মেনহাজুল হক
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেনহাজুল হক এখন একটি চিহ্নিত নাম। সহকর্মী ও ঠিকাদারদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘মাথা খারাপ স্যার’ নামে। অভিযোগের পাহাড় তার বিরুদ্ধে—দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য, সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অধস্তনদের লাঞ্ছনা এবং নারী সহকর্মীকে কটুক্তি করা। এসব অপকর্মের দীর্ঘ ইতিহাস তাকে পরিণত করেছে অধিদফতরের একজন ভয়ঙ্কর প্রতীক হিসেবে। তার হাতে পড়ে সৎ কর্মকর্তারাও পড়েছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া তার বেপরোয়া দাপট আজও থামেনি। বরং তার অবসরের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন উগ্র হয়ে উঠেছেন তিনি। দায়িত্বে থাকার সময়ে তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন ছাড়া কোনো ফাইল, এস্টিমেট, টেন্ডার বা রিভাইজড এস্টিমেন্ট পাশ করেননি। অভিযোগ আছে, নির্ধারিত কমিশন ছাড়া কোনো কাজের ফাইল তার টেবিল থেকে সামনে এগোয় না। কখনো নগদে, আবার কখনো বিকাশে টাকা আদায় করে নিয়েছেন ঠিকাদারদের কাছ থেকে।
শুধু আর্থিক নয়, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে সহকর্মীদের পদোন্নতি আটকে রাখার ঘটনাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, মেনহাজুল হক মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে নিজের অবস্থান শক্ত করে রেখেছেন। এক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবের প্রভাব ব্যবহার করে বছরের পর বছর নিজের ক্ষমতা বজায় রেখেছেন। এ অতিরিক্ত সচিব তার বাল্যবন্ধু বলেও জানা গেছে।
প্রতিবাদ করলেই শাস্তি—এটাই যেন তার নিয়ম। গোপালগঞ্জের এক নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিভার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ‘ঘুষ’ দাবি করে তত্বাবধায়ক মেনহাজুল হক। ঘুষ না পেয়ে তাকে মিটিংয়ে অপমান করেন এবং কটুক্তি করেন। অভিযোগ রয়েছে, নারী সহকর্মীদের সঙ্গেও তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এমনকি অতীতেওযৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে।
আরও পড়ুন<<>> আওয়ামী-আলতাফ সিন্ডিকেটে বন্দি শিক্ষা প্রকৌশল!
রংপুরে থাকা অবস্থায় ঠিকাদাররা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাটিকে ‘মাথার সমস্যা’ বলে পাশ কাটিয়ে যান। কিন্তু সেই সমস্যা আজও সমাধান হয়নি। বরং সময় পেরুতেই নতুন করে ফিরেছেন ঢাকা মেট্রো সার্কেলের দায়িত্বে। এবারের প্রত্যাবর্তন ছিল আরও ব্যয়বহুল ও পরিকল্পিত। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের বিনিময়ে তিনি এ দায়িত্ব আবারও ফিরে পান। তাতে সহায়তা করেন তারই বন্ধু প্রকৌশলী রায়হান বাদশা। যিনি সাজা এবং ওএসডি প্রাপ্ত।
ঢাকা মেট্রো সার্কেল, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এখন চলছে তার কমিশন বাণিজ্যের রাজত্ব। ঠিকাদারদের কাছ থেকে নির্ধারিত অঙ্ক আদায় না হলে কাজ থেমে থাকে। এমনকি সার্কেলের ভেতরের কর্মকর্তারাও তার হাত থেকে রেহাই পান না। কেউ কমিশন ছাড়া ফাইল পাস করলে তাকে সবার সামনে অপমানিত করা হয়।
ঢাকা সার্কেল এখন রীতিমতো একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ‘শিক্ষা ভবনের ইটপাটকেলও ঘুষ খায়’—এ ব্যঙ্গোক্তি এখন অনেকের মুখে মুখে। কারণ একটাই—মেনহাজুল হকের কৌশলী রাজত্ব। প্রধান প্রকৌশলী তার জুনিয়র হওয়ায় অন্য কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। এ সুযোগে তিনি নিজের কলমের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কমিশন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়।
এর আগে পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নারায়ণগঞ্জেও তিনি একই কায়দায় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কোথাও ঠিকাদারদের চাহিদামতো টাকা না পেলে বিল আটকে দিয়েছেন, কোথাও কাজের মান ত্যাগ করে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিয়েছেন। পঞ্চগড়ে কুশনের টাকা ভাগ করে নেয়ার অভিযোগে আন্দোলনের মুখে সরাসরি সার্কেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গিয়ে সমাধান করতে হয়। সেই সময়ও বলা হয়েছিল, ‘স্যারের মাথায় সমস্যা আছে’।
আরও পড়ুন<<>> শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান, হর্ষে আগমন বিষাদে বিদায়
নারায়ণগঞ্জে থাকার সময় আলোচিত এক প্রভাবশালী সাবেক এমপির শামীম ওসমানের গাড়িচালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে কাজ ভাগ করে নিয়েছিলেন তার বাল্যবন্ধু ঠিকাদারের মাধ্যমে। সেখানে প্রকল্পের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তিনি নিজেই। অবকাশ যাপনের জন্য প্রটোকল আদায়, জুনিয়রদের হেনস্তা এবং মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার ছিল তার নিয়মিত কর্মকাণ্ড।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ প্রকৌশলীকে বারবার অভিযোগের পরেও দফায় দফায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোনো তদন্ত, কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নীরব সমর্থন এবং কয়েকজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে গড়ে তুলেছেন একটি দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
অধিদফতরের সৎ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা এখন উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, ‘আমরা সততার সঙ্গে চাকরি করতে চাই, কিন্তু মেনহাজুল হকের কারণে বাইরে আমাদেরও বদনাম হতে হচ্ছে। মানুষ আমাদের দেখে বলে, ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না।”
প্রশ্ন উঠছে—মাত্র দেড় মাসের মাথায় অবসরে যাচ্ছেন এমন একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন এখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? কেন বারবার ‘মাথা খারাপ’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়?
দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে এখনই সময় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ভেতরের এ নীরব দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। না হলে মেনহাজুল হকের মতো কর্মকর্তারা বারবার ফিরে আসবেন ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে—কিন্তু একই দুর্নীতির ছায়া নিয়ে।
স্বভাবিকের বেশি কমিশন নেই না: মেনহাজুল
প্রাপ্ত সকল অভিযোগ প্রকৌশলী মেনহাজুল হকের সঙ্গে শেয়ার করেন প্রতিবেদক। তিনি একেএকে ব্যাখ্যা দেন। কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকৌশল সেক্টরে অনেক কিছু হয়, আমি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কমিশন কখনই নেই না। আপনি ঠিকাদরদের হাজির করলে সামনেই বলতে পারব যে তোমাদের কার কাছ থেকে বেশি নিয়েছি?
গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিভার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জুন মাসে গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সে ঠিকমতো কাজ তোলতে পারেনি। আর অগ্রিম বিল দিতে চায় না। আগে কাজ পরে বিল, এজন্য আমি তাকে বদলি করতে বলেছি।
‘মাথায় সমস্যা আছে’ প্রসঙ্গে মেনহাজুল হক বলেন, না, না, না। মাথা খারাপ করে কি আর ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ তোলা যাবে?
পিরোজপুর, পঞ্চগড় ও নারায়নগঞ্জের আত্মসাতের ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি রাগান্বিত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘সব কিছু লিখে দিন যা হবার হবে। আসসালামালাইকুম, আসসালামালাইকুম, আসসালামালাইকুম’-বলে ফোন কেটে দেন প্রবীণ এ প্রকৌশলী।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।