প্রতীকী কার্টুন
জুলাই–আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে গঠিত মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৭ নভেম্বর (সোমবার) এ মামলার প্রথম রায় ঘোষিত হবে বলে জানা গেছে। ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর এ রায়কে অনেকেই একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখছেন; একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা ও উত্তেজনা।
চব্বিশের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা একের পর এক ঝটিকা কর্মসূচির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দলটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও, সাম্প্রতিক দিনগুলোয় প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ ঘোষণা ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, আগুন লাগানো এবং নাশকতার ঘটনা সামনে আসে, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
সহিংসতার পুনরাবৃত্তি?
বিশ্লেষকদের মত, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালের সহিংস আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মতোই একটি চক্রে আটকে গেছে। ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অতীতে যেভাবে আওয়ামী লীগ রাজপথমুখী কর্মসূচিতে নেমেছিল, এবারও দলটির কিছু অংশ সেদিকেই ঝুঁকছে।
রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ এ বিষয়ে বলেন, আগামী দিনগুলোয় এমন আরও কর্মসূচি দেখা যাবে। বাস পোড়ানো, আগুন লাগানো এবং জনগণের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হওয়া যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং ক্ষমতার লড়াই পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করবে।
আরও পড়ুন<<>> জামায়াতকে সংসদে ‘থার্ড পার্টি’ দেখতে চায় বিএনপি
অন্যদিকে ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান মনে করেন, দলের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতা এখনও উল্লেখযোগ্য। তার ভাষায়, আওয়ামী লীগের হাতে অর্থ আছে, সংগঠন আছে। তাদের বহু নেতাকর্মীর কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে- যদিও এগুলোর সব ব্যবহার হবে এমনটি নিশ্চিত নয়। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হলে যে কোনো পক্ষের অস্থিতিশীল ব্যবহারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি
দলটির সাম্প্রতিক তৎপরতা প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট নাশকতামূলক ঘটনার উপস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অতিরিক্ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে বাধ্য করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, দলীয় নিষেধাজ্ঞার পরও সংগঠনটি যে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে- এমন আশা করা অবাস্তব ছিল। বরং নিষেধাজ্ঞা তাদের বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে থাকা সংগঠনের অংশগুলোকে আরও অপ্রত্যাশিত রূপে সক্রিয় করতে পারে।
ড. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে অগ্নিসংযোগ- এমন ঘটনাগুলো পূর্বেও দেখেছি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কিছু অংশের তৎপরতা সেই উদ্বেগ আবার সামনে আনছে। এসব অপতৎপরতা প্রতিহত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সরকারের বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের বিকেন্দ্রীভূত শক্তি আরও অনির্দেশ্য হয়ে ওঠে, কারণ আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামো তখন ভেঙে যায়। ফলে নেতৃত্বের নির্দিষ্ট কোনো আদেশ ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি বা নাশকতা ঘটতে পারে, যা রাষ্ট্রের জন্য বড় ঝুঁকি।
ট্রাইব্যুনালের রায় ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
১৭ নভেম্বরের রায়কে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রায় ঘোষণার আগে ও পরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, রায় যাই হোক না কেন, এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুতই রাজপথে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে, শুধু শেখ হাসিনার মামলাই নয়- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও কয়েকটি মামলার বিচারও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ধারাবাহিকভাবে এসব রায় ঘোষণার ফলে একই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন আরও জটিল হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান সুসংহত করতে ব্যস্ত। নির্বাচনী প্রস্তুতি যত এগোচ্ছে, সংঘাত-শঙ্কা ততই বাড়ছে। ট্রাইব্যুনালের রায় এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি- এ দুই ইস্যু একসঙ্গে মিলে আগামী কয়েক মাসকে দেশীয় রাজনীতির জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমীকরণ
গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগকে কার্যক্রম পরিচালনায় নিষিদ্ধ করা হয় এবং দলের নিবন্ধনও স্থগিত রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে ছাত্রলীগসহ দলটির অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে। রাজনৈতিক গবেষকদের মতে, এত বড় একটি দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে রাজনৈতিক ভাঙন, পুনর্গঠন বা নতুন উদীয়মান শক্তির জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
যদিও দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গত কয়েক মাসে প্রকাশ্যে খুব একটা সক্রিয় হয়নি, মাঠপর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে নানা ধরনের কর্মসূচি এবং প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে যে নিষেধাজ্ঞা দলকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে রাখতে পারেনি।
আরও পড়ুন<<>> আ.লীগ-জামায়াত অঘোষিত আঁতাত
এ অবস্থায়, রায়ের আগে–পরে দলটির নেতাকর্মীরা আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দলটি যদি রাজপথে সক্রিয় থাকে, তবে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হবে।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তৎপরতা ও নির্বাচনপূর্ব উত্তেজনা একই কেন্দ্রে এসে মিশেছে। রায়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, দেশজুড়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংঘাতের সম্ভাবনা ততই বাড়ছে। সরকারের জন্য এটি একটি বড় পরীক্ষা- কিভাবে তারা নিরাপত্তা বজায় রেখে, রাজনৈতিক দলগুলোর উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন রাখবে।
বিশ্লেষকদের মতে, সহিংসতার চক্র থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক দলের প্রতি সংযম ও রাষ্ট্রের প্রতি ন্যায়সংগত আচরণই সবচেয়ে জরুরি। তবে বাস্তবে আসন্ন সপ্তাহগুলোতে উত্তেজনার কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।





































