ছবি: আপন দেশ
দেড়যুগ ছিল দমন-পীড়ন, আন্দোলন। অবশেষে পিতন ঘটেছে স্বৈরাচার সরকারের। গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে নির্বাচন। সব কিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারিও প্রথম সপ্তাহেই। আর এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে- এ হিসাব এখন সরল। ফলাফল দেখতে সময়ের অপেক্ষা।
গুলশান ও লন্ডনে থাকা নীতিনির্ধারকরা ইতোমধ্যে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের পথনকশা তৈরি করেছেন। সেখানে মূল কথা- পরিচ্ছন্ন প্রার্থীর লড়াইয়ে ভোটের পর বিএনপির হাতে ক্ষমতা অর্জন করা। তাদের গঠিত সংসদে বহুদলীয় উপস্থিতি বজায় থাকবে, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে ‘একক আধিপত্যবাদী’ হিসেবে না দেখা যায়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি এবার এমন সংসদ গঠনের পথে যেখানে দলটি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে, বিরোধী দল হবে তাদের সহযোগী এনসিপি, এলডিপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় নাগরিক ঐক্য আর জামায়াত থাকবে সীমিত আসনের এক তৃতীয় বলয়ে।
বিএনপির কৌশল স্পষ্ট- ক্ষমতায় আসবে তারা নিজের শক্তিতে, কিন্তু বিরোধী রাজনীতিও থাকবে তাদের প্রভাবের আওতায়। এজন্য নির্বাচনে ৮০-৯০টি আসন ছাড়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব আসন পাবে এনসিপি, জাতীয় পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও হেফাজতে ইসলামসহ আরও কিছু দল। নির্বাচিত হলে তাদের সংসদে অবস্থান হবে ‘গঠনমূলক বিরোধী’ হিসেবে- সরকারের কাজের সমালোচনা করবে, কিন্তু কাঠামো নষ্ট করবে না।
জামায়াতের পিআর আন্দোলন এক রাজনৈতিক প্রতারণা: এনসিপি
স্থায়ী কমিটির এক জ্যেষ্ঠ সদস্য ‘আপন দেশ’-কে বলেন, আমরা চাই বিরোধী রাজনীতিও আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। গড়ে উঠুক দাতাগোষ্ঠি ও বহির্বিশ্বের পছন্দের নতুন প্লাটফর্ম। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতকে অতীতে আসন দিয়ে ভেশ ভোগতে হয়েছে। এবার তাদের নিজস্ব অস্তিত্বের পরীক্ষা দিক। বিএনপির আসন ছাড় দিয়ে সামনে আনলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে- তাই আমরা মাঝপথের সমাধান নিচ্ছি।
২০০১ সালের বিএনপি–জামায়াত জোট ছিল শক্তিশালী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে জামায়াত এখন অনেকটাই প্রান্তিক। তাদের প্রভাব টিকে আছে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি আসনে। তবে নানা কারণে জাতীয় জনপ্রিয়তাও সীমিত। বিএনপি নেতৃত্ব এখন মনে করে, জামায়াত সংসদে থাকুক,তবে প্রভাববিহীন। সময়ভেদে নৌকা ও ধানের শীষে ভর করা সংগঠনটি এবার হবে ‘থার্ড পার্টি’—প্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রভাবহীন।
বিএনপি বুঝেছে, ইসলামপন্থি ভোট পুরোপুরি হারালে মাঠের লড়াই কঠিন হবে। তাই এবার পরিকল্পনা- ভোট থাকবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণও থাকবে। এজন্য হেফাজতে ইসলাম ও এনসিপিকে সামনে আনা হচ্ছে। গুলশানে সম্প্রতি জুলাইযোদ্ধা সারজিস আলমের নেতৃত্বে এনসিপি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের। বৈঠকে নির্বাচনে প্রার্থী ও আসন নিয়ে আপাতত আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত হবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফেরার পর। এর আগে আলোচনা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে। আর বাকিগুলো যুগপদ আন্দোলনের সঙ্গী ছিলই।
একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করিছে বিএনপি। তাতে দেখা গেছে- বড় বিনিয়োগে বহুল প্রচার থাকলেও বাস্তবে জামায়াতের ভোট বিএনপির ছায়ায় চলে এসেছে। দেশের নির্বাচনের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৮টি আসন পেয়েছিল জামায়াত। ২০০১ সালে। তাতেও ছিল বিএনপির ছায়া। ২০০৮ সালে পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। তবে জরিপের মিলেছে, এবার জামায়াতের ভোটের হার কিছুটা বাড়বে।
পালানো নেতাদের পুনর্বাসনে রাজনৈতিক দৌড়
দলীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ভোটের মাধ্যমে আগের মতো পূর্ণ ক্ষমতা পেলেও এবার বিএনপি চাইছে একটি ‘সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ’। জাতীয় পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসবে, তবে তারা সরকারবিরোধী সংঘাত সৃষ্টি করবে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন,আমরা এখন এক ধরনের সংসদীয় ভারসাম্য তৈরি করতে চাইছি- যেখানে গণতন্ত্রও থাকবে, নিয়ন্ত্রণও থাকবে। ভোটের মাঠে লড়াইয়ে জামায়াতের হাতে যেতে পারে মাত্র ১০-১৫টি আসন। যা নতুন দল এনসিপিরও পরে। ফলে জামায়াত থাকবে সংসদে, কিন্তু প্রভাব হারাবে পুরোপুরি।
বিএনপি এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী সরকার’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার নকশা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার সংকেত দিয়েছে- জামায়াতকে সামনে রাখলে নতুন সরকারকে নানা জটিলতার জালে আটকাতে হবে। দলটির এক পরামর্শক বলেন, আমরা এমন সরকার চাই যেটি রিয়াদ, ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস- তিন জায়গাতেই গ্রহণযোগ্য। জামায়াতকে সামনে আসতে দেয়া মানেই রাজনৈতিক আত্মঘাত।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বিএনপি নিজস্ব প্রার্থী দিচ্ছে- যেখানে একসময় জামায়াতের আধিপত্য ছিল। রাজশাহী, রংপুরেও একই কৌশল- জামায়াতের প্রভাব মেপে দেখা এবং ভোটে তাদের প্রান্তিক করা। অন্যদিকে উত্তরে ও দক্ষিণে এনসিপি ও জাতীয় নাগরিক ঐক্যকে সুযোগ দিচ্ছে বিএনপি, যাতে ধর্মীয় ভোট বিভাজিত হয়। মাঠের এক তরুণ নেতা বলেন, এখন মাঠে জামায়াতের অস্তিত্ব আওয়াজে। ভোটাররা বিএনপির পতাকা খুঁজছে, জামায়াতের না। সাধারণ মানুষ ধর্মের নামে রাজনীতিকে প্রথমে গ্রহণ করলেও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া তার বড় প্রমাণ।
আরও পড়ুন<<>> আ.লীগ-জামায়াত অঘোষিত আঁতাত: জেন-জির রক্তের সঙ্গে বেঈমানি!
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ‘আপন দেশ’-কে বলেন, বিএনপি এবার এক নতুন সংসদীয় মডেল তৈরি করতে যাচ্ছে- সরকার থাকবে তাদের হাতে, বিরোধী দলও হবে তাদের আশ্রিত। এ মডেলে জামায়াত তৃতীয় সারিতে ঠাঁই পাবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকবে বাইরে। এ কাঠামো কার্যকর হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৈরি হবে তিনটি স্তর- প্রথমত বিএনপির সরকার, দ্বিতীয়ত সহযোগী বিরোধী জোট (জাতীয় পার্টি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপি), তৃতীয়ত প্রান্তিক ইসলামী ব্লক (জামায়াত ও ক্ষুদ্র দলসমূহ)। এতে রাজনৈতিক স্থিতি ও আন্তর্জাতিক আস্থা দুটোই টিকে থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও মেরুকরণের পথে, তবে এবার দিকনির্দেশনা ভিন্ন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরছে নতুন ভাবনায়- ধর্মীয় ভোট ধরে রেখে আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জন, বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ কৌশল সফল হলে জামায়াত আর কখনো রাজনীতির কেন্দ্রে ফিরবে না। তারা থাকবে সংসদে ‘থার্ড পার্টি’ হিসেবে- মাত্র দশ-পনেরোটি আসনে, নামমাত্র প্রভাব নিয়ে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































