Apan Desh | আপন দেশ

আইনশূন্যতায় ধর্ম ‘যায়নবাদী’র সংখ্যা বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক 

প্রকাশিত: ২১:৪১, ৫ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ২১:৫২, ৫ অক্টোবর ২০২৫

আইনশূন্যতায় ধর্ম ‘যায়নবাদী’র সংখ্যা বাড়ছে

অপূর্ব পাল।

বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননা বিষয়ে কঠোর ও নির্দিষ্ট আইন না থাকায় বারবার ঘটছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা। রাজধানীর বসুন্ধরায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপূর্ব পালের কাণ্ড যেন সে শূন্যতারই প্রতিচ্ছবি। পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননায় ক্ষুব্ধ জনতা তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও নিন্দার ঝড় বয়েছে। আর আইনের শূন্যতার সুযোগ নিয়ে এ ধরনের উসকানিমূলক কার্যক্রম ছড়াচ্ছে অপূর্ব পালের মতো ‘যায়নবাদী’।

শনিবার (০৪ অক্টোবর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঘটে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সকাল ৯টার দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপূর্ব পাল ঠোঁটে শিস বাজাতে বাজাতে পবিত্র কোরআন শরীফ পদদলিত করে। এ জঘন্য দৃশ্যের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে সারাদেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর আঘাত লাগে এ অপমানজনক ঘটনায়।

তবে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। ঘটনাটি সকালেই ঘটলেও ভিডিও ভাইরাল হয় রাত ১১টার দিকে। আর অপূর্ব পালকে গ্রেফতার করা হয় রাত ২টার দিকে। এত দীর্ঘ সময় প্রশাসন কী করেছে? প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়—অভিযুক্তকে শুরু থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি অতীতে দেখা গেছে, একই বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষককে কেবল ক্লাসে হাদিস উদ্ধৃত করায় বরখাস্ত করেছিল। অথচ কুরআন পদদলনের মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটলেও প্রথম পর্যায়ে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি—যা প্রশাসনের দ্বিচারিতার স্পষ্ট উদাহরণ।

আরও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে “মানসিক রোগ” তত্ত্ব। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর কিছু মহল অপূর্ব পালকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে আখ্যায়িত করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—একজন সত্যিকারের মানসিক রোগী কীভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়, ফলাফল বজায় রাখে? ও কেন এ কথিত “মানসিক রোগীরা” সবসময় ইসলাম ধর্মকেই আঘাত করে, অন্য কোনো ধর্মকে নয়?

অপূর্ব পালের নিজের বক্তব্যেও উঠে এসেছে উদ্বেগজনক ইঙ্গিত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সে প্রকাশ্যে বলেছে, আমার পেছনে শক্তিশালী ব্যাকআপ আছে, কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না। এ বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, ঘটনাটি কেবল ব্যক্তিগত বিকৃত মানসিকতার নয়; বরং এর পেছনে থাকতে পারে সংগঠিত একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। কারা সে গোষ্ঠী? তাদের উদ্দেশ্য কী?—এ প্রশ্ন এখন সারা দেশের মানুষের মুখে।

আরও পড়ুন>>>বিএনপির চারপাশে বাড়ছে চাপ, প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

ইসলামী স্কলার মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন হলে, মানসিক হাসপাতালে যাবে। অথবা যাবে রিহ‍্যাব সেন্টারে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন? এ ঘটনার পেছনে দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়ে তিনি। তিনি আরও বলেনছেন, দেশের এ ক্রান্তিকালে কেউ সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে দা * ঙ্গা-হা*ঙ্গামা লাগাতে চাচ্ছে কি না— সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। এটা দেশকে অশান্ত করার একটি নীলনকশার অংশও হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অপূর্ব পালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন আজহারী। লিখেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই কুলাঙ্গারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই; যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা না দেখায়।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপূর্ব পালের পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনায় দেশের প্রধান ইসলামি সংগঠনগুলো তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম এক যৌথ প্রতিবাদ বার্তায় বলেন, পবিত্র কোরআন মুসলিম উম্মাহর হেদায়েতের জন্য নাজিল হয়েছে। মুসলমানরা এ পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। এ ঘটনা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। নেতারা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। তারা আরও বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাটি কোনো ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। ধর্মীয় সহাবস্থান রক্ষা করতে হলে কঠোর আইন প্রণয়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার নীতি প্রণয়ন জরুরি বলে তারা মত দেন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমানও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অবিলম্বে অপূর্ব পালের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ভাইরাল ভিডিওতে তার অঙ্গভঙ্গি ও উগ্রতা দেখে তাকে পাগল মনে হয়নি। মনে হয়েছে— এ ঘটনাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তারা অপূর্ব পালের পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো এজেন্সির সম্পৃক্ততা থাকলে তা খুঁজে বের করার দাবি জানান। নেতারা হুঁশিয়ারি দেন যে, সরকার যদি কোরআন অবমাননাকারী অপূর্ব পালের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত না করে, তবে তারা দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ডাক দিতে বাধ্য হবেন। তারা অতীতের ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা উল্লেখ করে বলেন, ফিলিস্তিন থেকে বাংলাদেশ—সবখানে একই চিত্র। তারা আর প্রতারিত হতে চান না। ধর্ম অবমাননা রোধ করতে হলে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করার কোনো বিকল্প নেই বলে তারা জোর দেন।

আরও পড়ুন>>>কোরআন অবমাননার অভিযোগে শিক্ষার্থীকে গণপিটুনি

ইসলামী আলোচক শায়েখ আহমাদুল্লাহ বলেন, অপূর্ব পাল যা করেছে, এটা ধর্মীয় দাঙ্গা বাঁধানোর সুস্পষ্ট উসকানি। আমরা অবিলম্বে তার দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। তিনি সরকারের প্রতি অবিলম্বে ধর্ম অবমাননা বিষয়ে কঠোর ও সুস্পষ্ট আইন তৈরি করে এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটানোর দাবি জানান।

এ ঘটনা আবারও বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননা বিষয়ে কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম অবমাননা বিষয়ে বাংলাদেশে এখনও কঠোর ও সুস্পষ্ট আইন তৈরি করা নেই। এ দুর্বলতার সুযোগে বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষায় কঠোর আইন গ্রহণ করেছে। ডেনমার্ক সরকার কোরআনসহ পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো বা অপবিত্র করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। আইনটি দেশের দণ্ডবিধির ১২ অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইন ভঙ্গকারীদের জরিমানা বা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ডেনমার্কের বিচারমন্ত্রী পিটার হামেলগার্ড জানান, এ আইন জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য হবে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় জামফারা প্রদেশে পবিত্র কোরআন অবমাননার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে।

এ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি কার্যকর, কঠোর ও সুনির্দিষ্ট ধর্ম অবমাননা আইন প্রণয়ন করা অপরিহার্য। কঠোর আইনের অভাবেই অপূর্ব পালের মতো উগ্রপন্থীদের বারবার উত্থান ঘটছে। যা দেশের সামাজিক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের জন্য মারাত্মক হুমকি।

একই সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। বহুদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, কিছু প্রতিষ্ঠান ইসলামবিরোধী মনোভাব পোষণ করে, ধর্মীয় মূল্যবোধকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দেখে। হাদিস উদ্ধৃতির ঘটনায় শিক্ষক বরখাস্ত ও সাম্প্রতিক কুরআন অবমাননা—দুটি ঘটনাই সেই অভিযোগকে নতুনভাবে উসকে দিয়েছে।

একটি মুসলিমপ্রধান দেশে এমন জঘন্য কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই। তবুও দেখা যায়, বিদ্যমান আইনে ধর্ম অবমাননার বিষয়ে নির্দিষ্ট ও কঠোর শাস্তির বিধান না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটছে। ধর্ম অবমাননা প্রতিরোধে এখনই প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট আইন ও তার কঠোর বাস্তবায়ন। নতুবা অপূর্ব পালের মতো মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিকে পদদলিত করে আরও বড় অনিষ্টের বীজ বপন করবে। দেশের শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ জরুরি।

বিশ্লেষকরা বলছেন—ধর্ম অবমাননার মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে আইন যদি কঠোর ও সুঅস্পষ্ট থাকে তখন আর অপূর্ব পালের মতো যায়নবাদী ধর্ম অবমাননার মতো কাজ করতে সাহস পাবে না।

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়