ফাতেমা আক্তার
দশম গ্রেড বাস্তবায়নসহ তিন দফা দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তাল ছিল দেশজুড়ে। সে দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়েই চাঁদপুরের উত্তর মতলবের ৫ নম্বর ঝিনাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ফাতেমা আক্তার পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজধানীতে।
নিজের বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য, সহকর্মীদের জন্য, এবং নিজ পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য তিনি এ আন্দোলনের অংশ হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মিছিলই হয়ে দাঁড়াল তার জীবনের শেষ অঙ্গীকার।
গত ৮ নভেম্বর শাহবাগে শিক্ষকদের কলম বিরতির দিনে হাজারো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিলেন ফাতেমা। দাবি আদায়ে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে যেন থমকে যায় তার হৃদস্পন্দন। সহকর্মীরা জানান, শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমা অসুস্থ হয়ে পড়েন, আতঙ্কে কাঁপতে থাকেন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু অবস্থার অবনতি থামেনি।
তার সঙ্গে থাকা সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি। ‘আমরা একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম’- তিনি বললেন। ‘শিক্ষকের মর্যাদা, জীবন-জীবিকা আর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আপা ভীষণ ভয় পেয়ে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। আইসিইউতে ছিলেন বহুদিন… আজ সকাল ১০টার দিকে খবর পেলাম, উনি আর নেই।’

মিরপুরের অলক হাসপাতালে দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে থেমে গেল ফাতেমার নিঃশ্বাস। হাসপাতালের সাদা দেয়ালে শেষ কয়েকটা দিন ছিল তার দুই সন্তানের জন্য নিঃশব্দ আকুলতা আর স্বামীর অপেক্ষা। স্বামী ডিএম সোলায়মান, শোক-বিধ্বস্ত কণ্ঠে জানালেন, আমাদের দুই বাচ্চা এখনো বুঝতেই পারছে না কেন মা ফিরছে না। ওর স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা আর সন্তানদের নিয়ে শান্ত একটা জীবন… সেই স্বপ্ন কীভাবে ভেঙে গেল হঠাৎ!
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ জানান, আন্দোলনের সময় আহত হয়েই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ফাতেমা। আন্দোলনকারীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ‘আমাদের একজন সহকর্মীকে হারালাম শুধু ন্যায্য দাবি আদায়ের পথে দাঁড়ানোর কারণে,’ তিনি বলেন। আজ আমরা তার বাড়ির পথে রওনা হয়েছি। পরিস্থিতি বোঝার পর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেব।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (শাহীন–লিপি) নেত্রী খায়রুন নাহার লিপিও গভীর শোক জানিয়েছেন। তিনি বলেন, একজন শিক্ষক আন্দোলনে অংশ নিতে এসে নিজের জীবন দিয়ে দিলেন। এটা শুধু আমাদের আন্দোলনের নয়, পুরো জাতির জন্যই একটা বেদনাদায়ক ঘটনা।
শিক্ষক ফাতেমা আক্তার ছিলেন দুই সন্তানের মা- তাদের ছোট ছোট হাত দুটো এখনো অপেক্ষায়, হয়তো ভাবছে মা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে কোনো এক বিকেলে, ক্লাসের গল্প বলবে, মিষ্টি হেসে খাওয়াবে। কিন্তু সেই দরজা আর খুলবে না কোনোদিন। মায়ের নিস্তব্ধ দেহ এখন ফিরছে চাঁদপুরের উত্তর মতলবে, পরিচিত উঠোনে, পরিচিত মুখগুলোর মাঝে, কিন্তু আগের মতো প্রাণভরে হাসতে নয়—চিরবিদায়ের জন্য।
গ্রামে ইতোমধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্থানীয়রা জানান, বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চোখে পানি- তাদের ‘আপু ম্যাডাম’ আর আসবেন না। যেসব ছোট্ট হাত ধরেছিলেন তিনি, যাদের অক্ষর শেখাতেন ভালোবাসায়, তাদের বুকেও ভারী হয়ে আছে হঠাৎ শূন্যতা।
রাতেই তার জানাজা এবং দাফনের প্রস্তুতি চলছে। স্বজনরা বলছেন, ফাতেমা ছিলেন পরিবার ও সমাজের কাছে নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ। শিক্ষকতার মতো পবিত্র পেশাকে তিনি শুধু চাকরি হিসেবে নয়, দায়িত্ব ও ভালোবাসা হিসেবে ধারণ করতেন। তার অকাল মৃত্যু আন্দোলনের পথের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে থাকবে বহুদিন।
ফাতেমা আক্তারের মৃত্যুশোক শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং দেশের হাজারো শিক্ষক-শিক্ষিকার হৃদয়ের ব্যথা। তার মতো একজন শিক্ষিকার স্বপ্ন, সংগ্রাম আর উৎসর্গ আজ থেমে গেল ঠিকই- কিন্তু তিনি রেখে গেলেন প্রশ্ন, রেখে গেলেন ক্ষত, রেখে গেলেন এক অসমাপ্ত লড়াইয়ের ইতিহাস।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।





































