
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের সংস্কৃতি আজ এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় গড়া সংগঠনগুলো মুক্তচিন্তা, মানবিকতা ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনৈতিক উদাসীনতার চাপে সাংস্কৃতিক পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাটি যেন সে সংকোচনের চূড়ান্ত রূপ।
ঘটনাটি শুধু একটি ছবি থামানোর কাহিনি নয়—এটি সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ওপরে এক গভীর মৌলবাদী আঘাত, যা সরকার ও সমাজের নীরবতা দিয়ে বৈধতা পাচ্ছে।
‘তাণ্ডব’ বিতর্ক: একটা ছবি, এক বিশাল প্রতিক্রিয়া
১০ জুন, ২০২৫। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ এলাকায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টারে শাকিব খান অভিনীত সিনেমা ‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনের তৃতীয় দিনে এসে আয়োজকরা সিনেমা চালানো বন্ধ করে দেন। কারণ, স্থানীয় ‘পারকি ইউনিয়ন ওলামা পরিষদ’ সিনেমা প্রদর্শন বন্ধে আন্দোলনে নামে, বিক্ষোভ করে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন দেয়।
হলটি ভাড়া নিয়ে এক মাসের প্রদর্শনীর পরিকল্পনা থাকলেও মাত্র আড়াই দিনই ছবিটি চালানো সম্ভব হয়েছে। আয়োজক সাজু মেহেদী বলেন, ৯ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এসি সার্ভিসিং, টিকেট ছাপা, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ—সবকিছু আমরা প্রস্তুত করেছিলাম। দর্শকদের ভালো সাড়া পেয়েছিলাম, কিন্তু আলেমদের আপত্তির কারণে থামিয়ে দিতে হয়েছে। সহ-আয়োজক কামরুজ্জামান সাইফুল বলেন, ব্যানার লাগাতে পারিনি, প্রচার করতে পারিনি, হুমকি-ধামকি এসেছিল। এরপরও আমরা চালিয়েছিলাম। কিন্তু টিকিয়ে রাখতে পারিনি।
বিক্ষোভকারী আলেমরা বলছেন, সিনেমা হলে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ বাড়বে, মসজিদ-মাদ্রাসায় পাঠদানে ক্ষতি হবে। এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, অভিযোগ পেয়েছিলেন, তবে ঈদের ছুটির কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। থানা পুলিশ বলছে, তারা কেবল অভিযোগ শুনেছেন, কোনো পদক্ষেপ নেননি।
প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হচ্ছে
এ ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সিনেমাপ্রেমী প্রতিবাদ করলেও কোথাও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ দেখা যায়নি। দেশে যখন মৌলবাদী গোষ্ঠী সরাসরি সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়, তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। অতীতে আমরা দেখেছি, উদীচীর কর্মশালায় হামলা, ছায়ানটের বৈশাখী অনুষ্ঠান বাতিলের চাপ, বাউল গানের দলকে মাঠছাড়া করা কিংবা কবিতা পাঠের আসরে পুলিশের অনুমতি ছাড়া সভা না করার বিধিনিষেধ। প্রতিবারই মুক্তবুদ্ধির পরিসর সংকুচিত হয়েছে। এ ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতার নতুন কিস্তি।
রাষ্ট্র কি পৃষ্ঠপোষক, না পর্যবেক্ষক?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযানের নামে গণতন্ত্রের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের কোনো সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বরং নতুন সরকারের মেয়াদে সাংস্কৃতিক বাজেট কাটছাঁট করা হয়েছে, জেলা পর্যায়ের শিল্পকলা অ্যাকাডেমিগুলোর আধুনিকায়ন স্থবির হয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন মৌলবাদীদের চাপের মুখে নতিস্বীকার করছে। টাঙ্গাইলের এ ঘটনার পরও কোনো কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় বা তথ্যমন্ত্রী কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি।
সরকারের এ নীরবতা শুধু দায় এড়ানো নয়, এটি মৌলবাদকে কার্যত লাইসেন্স দেয়া।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দেশের ভাবমূর্তি
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক পরিসরে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হস্তক্ষেপ বহুবার আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০০১ সালের উদীচী হামলা, ২০১৩ সালে বাউল গান নিষিদ্ধের চেষ্টা, কিংবা ২০২২ সালের লোকনাট্যদলকে হুমকি—এসব ঘটনা বিদেশি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার নজরে এসেছে। এবারও ‘তাণ্ডব’ সিনেমা বন্ধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সংস্থা এবং দক্ষিণ এশীয় শিল্পী মঞ্চগুলোর মধ্য থেকে উদ্বেগের সুর শোনা যাচ্ছে।
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতি এমন অবহেলা বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে অসহিষ্ণু ও রক্ষণশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা শুধু বিনিয়োগ নয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও উন্নয়ন সহযোগিতাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আর্তনাদ
দেশের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উদীচী’ বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু সংবিধানে নয়, বাস্তবে প্রয়োগে প্রমাণিত হয়। আমরা বহুবার হামলা ও বাধার মুখে অনুষ্ঠান করেছি, কিন্তু এখন আর সাহস পাই না, কারণ সরকার পাশে থাকে না। ছায়ানটের এক সংগঠক বলেন, পহেলা বৈশাখ আজ ঢাকায় বেঁচে থাকলেও ছোট শহরগুলোয় প্যান্ডেল বানানো যায় না হুমকির ভয়ে।
করণীয়-১) রাষ্ট্রীয় অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি। সরকারকে বলতে হবে, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার এবং তা রক্ষায় প্রশাসন সক্রিয় থাকবে। ২) সাংস্কৃতিক বাজেট বাড়াতে হবে, বিশেষ করে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকলা চর্চায় বরাদ্দ ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ৩) মৌলবাদী হুমকির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে যারা সাংস্কৃতিক আয়োজন ভাঙচুর বা হুমকি দেয় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৪) আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও পর্যবেক্ষণ টানতে হবে। যেন এ ধরণের ঘটনায় বৈশ্বিক সংগঠনগুলো সচেতন থাকে এবং রাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
‘তাণ্ডব’ সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু প্রশ্ন জিইয়ে রেখেছে—এ সমাজে কীভাবে একটি সিনেমার আয়োজন একটি যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়ায়? কেন প্রশাসন নীরব থাকে? কেন দেশের সংস্কৃতি মৌলবাদীদের হাতে জিম্মি হয়, আর সরকার চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যায়?
আজ বাংলাদেশকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে—আমরা কি একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র চাই, নাকি একটি ভীত, সংকুচিত সমাজ, যেখানে মৌলবাদীদের চোখ রাঙানিতেই শিল্প থেমে যাবে?
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।