জামিল হোসেন ও মনিরুজ্মামান
সরকারি মাল দরিয়ায় ঢেলেছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী জামিল হোসেন। সাবেক ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের এ নেতা ঠিকাদারদের নিয়ে সরকারি টাকা ভাগবাটোয়ারা করেছেন। যেখানে যা প্রয়োজন ভিজিট করে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন প্রয়োজনের দিগুনেরও বেশি। আবার কখনও কাজ না করেই বিল পরিশোধ করেছেন। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক নিজেই নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেছেন।
এদিকে মাফিয়া শেখ হাসিনার জমানায় অন্যান্য সেক্টরের মতো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরেও তৈরী হয়েছে ‘ডিপার্টমেন্টাল মাফিয়া’। এদের একজন উপ-সহকারীপ্রকৌশলী এ কে এম মনিরুজ্জামান। নির্বাহী প্রকৌশলীর অধিনে কাজ বরাদ্দ হলেও ইজিপির দায়িত্বে তিনি। মনিরুজ্জমানের হাতেই ঠিকাদারের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। কে কাজ পাবেন-তা ঠিক করেন তিনি। আর পাওয়া-না পাওয়ার জন্য তিনি করে থাকেন ঠিকাদারের দাখিলকৃত ফাইল থেকে কাগজ চুরির মতো গর্হিত কাজ।
তিনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অংশীজনও, তাই থাকেন নেপথ্যে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়াসহ বহু অভিযোগের কারণে সম্প্রতি ঠিকাদার বাবুর নেতৃত্বে হিটু, রাশেদ ও জয়রা এই ‘ডিপার্টমেন্টাল মাফিয়া’ মনিরুজ্জামানকে লাঞ্ছিত করেছিল। পরে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়। কিন্তু থেমে থাকেনি মনিরের আধিপত্য।
কিছুদিন আগেও শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রাসেল। তার বিরুদ্ধে জুলাইযোদ্ধা হত্যার ৬টি মামলা রয়েছে। তারই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এস এস এনটারপ্রাইজের নামে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার কাজ পেতে সহায়তা করেছেন মাফিয়া মনিরুজ্জামান। রাজধানীর বনানীর আপিএস স্কুলের অনুকুলে বরাদ্দ হয়েছে এ টাকা।
ফরিদপুর আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘ইয়াছিন এন্টারপ্রাইজ’এর নামে আগারগাঁও মহিলা পলিটেকনিক্যালের জন্য বরাদ্দ ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার কাজ দিয়েছে। এর আগে ইডেন কলেজের অনুকুলে বরাদ্দপ্রাপ্ত ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কাজও মিলিয়ে দিয়েছেন ওই ইয়াছিনের প্রতিষ্ঠানকে। হাসিনার জমানায় পাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে ওই ইয়াছির এনটারপ্রাইজের নামেই।
মনিরুজ্জামানের সহকর্মীদের একজন সহকারী প্রকৌশলী (উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা) এ প্রতিবেদককে বলেন,‘ভাই, যে অভিযোগ উঠেছে তার দ্বিমত করব না, তবে মনিরুজ্জামানের হাত দু’টি নয়, এক্সেন স্যারের হাত দুটিও তিনি ব্যবহার করেন। ঠিকাদারের পিসির পরই কিন্তু তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেন। বসের সিগন্যাল ছাড়া ফাইলে হেরফের করার মতো সাহস সহকারী প্রকৌশলী মনিরের হবে না। বসের অর্ডার ফলো করতে গিয়ে আমাদের হাতে রশি লাগে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে মনিরুজ্জামানকে ০১৭৩৮...৪৭ নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াট্স অ্যাপে পাঠানো ক্ষুদে বার্তার উত্তর এখনো মিলেনি।
জামিলের দুর্নীতি: প্রধান শিক্ষক জানেন না তার স্কুলে না কী কাজ হচ্ছে
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ঢাকা জেলার অধীনে সূত্রাপুর থানা। এখানে দায়িত্বে আছেন সহকারী প্রকৌশলী জামিল হোসেন। সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা ইডিতে যোগদানের পরই নাম লেখান বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদে। এ পরিষদের শীর্ষ নেতা জাফর সিকদার ও সিরাজের স্নেহভাজন তিনি। সরকারি কর্মকর্তা হলেও দলীয় আদর্শের বিচ্যুতি ঘটাননি একটুও। টাঙ্গাইলের বাসিন্দা জামিলকে শিক্ষা ভবন চেনে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী পলাতক জাহিদ মালেক স্বপনের স্বজন হিসেবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সরকার কর্মসূচি ব্যয় বরাদ্দপত্র দিয়ে থাকেন। সে পত্র নিয়ে মাঠে নামেন জামিল হোসেন। ১টাকার বরাদ্দকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ২টাকা করার সুপারিশ করেন। তার সুপারিশ আমলে নেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। কারণ তাতে আছে পিসি। এরপর টেন্ডার, অতঃপর সে-ই মনিরুজ্জামানের সহায়তা নেন বরাবরের মতো। বাছাই হয় দলীয় আদর্শের ঠিকাদার। দাতা-গ্রহিতা মিলে মিশে চালান লুটিপাট। ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ওযুখানা সংস্কারের জন্য কর্মসূচি ব্যয় ধরা হয় ৪ লাখ টাকা। কিন্তু জামিলের চাহিদায় সে বরাদ্দ দিতে হয় ৭ লাখ ৪ হাজার টাকা। ওই কাজ পেয়েছিলেন মেসার্স মিরন এন্টারপ্রাইজ।
জানতে চাইলে ওই স্কুলের শিক্ষকরা বলেন, ওযুখানা নতুন করে তৈরী করতেও ৭ লাখ টাকা লাগার কথা না, বুঝে নিন সেখানে সংস্কারেই ৭ লাখ! সরকারি টাকা না? কতোজনের হক আছে...।
এমন কাজ শুধু ওই উচ্চ বিদ্যালয়েই নয় ঘটেছে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও। প্রশাসনিক ভবনে ছাদের পানি বন্ধকরাসহ অন্যান্য মেরামত ও সংস্কার বিল দেয়া হয়েছে ২৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এখনে কর্মসূচি বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ টাকা। জামিলের কলমের খোচায় তা ২৪ লাখে পৌছেছে। ২০২০-১৯ অর্থ বছরের ওই কাজের ঠিকাদার ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমানের প্রতিষ্ঠান রিফাত এন্টারপ্রাইজ।
একনজরে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কাজ
২০২০-২১ অর্থ বছরে সীমানা প্রাচীর মেরামতসহ রং করন কাজ। ব্যয় ৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুরজাহান কনষ্ট্রাকশন। প্রধান গেটের মেরামত ও সংস্কার কাজের ব্যয় ৬ লাখ ৩৬ হাজার। প্রাপ্ত ঠিকাদার সাইফুল এন্ড কোং। আভ্যন্তরীণ রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজের ব্যয় হয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। কাজটি দেয়া হয় -এর প্রাপ্ত ঠিকাদার শাম্মি এন্ট্রারপ্রাইজ। প্রশাসনিক কাম অ্যাকাডেমিক ভবন টাইলস করন, দরজা-জানালা পরিবর্তন ও রং করনের কাজে ব্যয় হয় ৫ লাখ লাখ ২৩ হাজার টাকা। মেসার্স নিশান কনষ্ট্রাকশন কাজটি করেন। একই ঠিকাদার বিদ্যালয়ের টিনসেড ভবনের মেরাতম ও সংস্কার কাজের বিল নেয় ৮ লাখ ৯১ হাজার, ড্রেনেজ ব্যবস্থা মেরামত ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। শুধু মটর রুম নির্মাণ ও টয়লেট সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা করেছে, রাশা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা ব্যয়ে কম্পিউটার ল্যাব শীততাপ করনের কাজ করেছেন মেসার্স ব্লু-বেল এন্ট্রারপ্রাইজ, একই বছর অ্যাকাডেমিক ভবন ১ ও ২-এর বৈদ্যুতিকর মেরামত ও সংস্কার ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। যা করেছে মেসার্স দোহা ট্রেডার্স। আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমানের প্রতিষ্ঠান- রিফাত এন্টারপ্রাইজ বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে ছাদের পানি বন্ধকরাসহ অন্যান্য মেরামত ও সংস্কার বাবদ বিল নিয়েছেন ২৪ লাখ ১৪ হাজার। যার কর্মসূচি বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ টাকা।
ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ দেয়া হয়েছিল হোমল্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেডকে ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকায়, টিফিন রুম, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রধান শিক্ষকের বাসভবন মেরামত ও সংস্কার কাজ দেয়া হয় ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকায়। দেশ করপোরেশনকে কাজটি দেয়া হয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরে একই স্কুলের সার্বিক মেরামত ও সংস্কার কাজ পানসি কনষ্ট্রাকশনকে দেয়া হয় ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকায়। শুধু বারান্দার গ্রীল মেরামতের জন্যই ২০২০-২১ অর্থ বছরে মেসার্স লি সিন্ডিকেটকে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
আভ্যন্তরীণ রাস্তা মেরামত (২০২০-২১) ৩ লাখ ৮৮ হাজার পায় এম এ সুমন এন্টারপ্রাইজ, ড্রেন সংস্কার ও মেরামত (২০২০-২১) করতে ১০ লাখ ৪৬ হাজার পায় এম এ সুমন এন্টারপ্রাইজ। মেসার্স মিরণ এন্টারপ্রাইজকে ওযুখানা সংস্কার করতে দেয়া হয় ৭ লাখ ৪ হাজার টাকা। অ্যাকাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবনের বৈদ্যুতিক মেরামত ও সংস্কারের বিল (২০২০-২১) ৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা পায় সোহাগ কনষ্ট্রাকশন।
স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেস্ট ওস্মার্ট বোর্ড স্থাপন (২০২০-২১) বাবদ মেসার্স জয় কনষ্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লাইয়ার্স নেয় ৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা আর মেসার্স তারেক এন্টারপ্রাইজ
কম্পিউটার ল্যাব ও শীতাতপ করণ বাবদ নেন (২০২০-২১) ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

কাজ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সৈয়দা আক্তার ডেইলি আপন দেশ ডটকম’কে বলেন, আমার স্কুলের কিছু কাজ হয়েছে। তবে সেকাজ নিন্মমানের; যদি শতকরা ৪০-৫০ভাগও হতো আমি খুশি হতাম। ২০-২৫% কাজও হয়েছে কিনা সন্দেহ। ঠিকাদার কী দরজা লাগিয়েছে ক’দিন আগে তা ভেঙ্গে পড়েছে।
সম্প্রতি ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বিদ্যালয়ের ৬ তলা ভবন নির্মানের কাজ পরিদর্শনে গেলে সৈয়দা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার স্কুলে কোনো সময় কী কাজ হয়েছে, হচ্ছে আমি নিজেই জানি না। যে কাজগুলো দেখা যায় সেগুলোও নিন্মমানের।’ ক্ষোভের কোনো জবাব দেননি নির্বাহী প্রকৌশলী।
যা বললেন মনিরুজ্জামান
আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান বলেন, আমি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কেউ না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ঠিকাদার বাবুর নেতৃত্বে হিটু, রাশেদ ও জয়রা আমার অফিসে এসে উচ্চস্বরে কথা বলেছেন। তারজন্য তারা সরিও বলেছেন।
জামিল হোসেনের বক্তব্য
সহকারী প্রকৌশলী জামিলের কাছে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ তো আমি দেই না। আমি তদারকি করি। তবে যেসব কাজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে হয়েছে। বিল আমি করে দেই উপরের স্যারেরা বিল দেন। সাবেক স্বাস্ব্যমন্ত্রীকে আমি চিনিও না।’ সূত্রপুরে তার চাকরির বয়স তিন বছরের বেশি হয়েছে বলে জানান জামিল।
নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। ও ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলে ফিরতি বার্তায় জানান পরে ফোন দিবেন। তবে তিনি সন্ধ্যা সোয়া ৬টা নাগাদ কোনো বক্তব্য দেননি।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































