প্রতীকী কার্টুন
বাংলাদেশের রাজনীতি এক অগ্নিগর্ভ মোড়ে দাঁড়িয়েছে। টগবগ করছে রাজনৈতিক উত্তাপ। নির্বাচন, জুলাই সনদ ও গণভোট- এ তিন ইস্যুর জট রাষ্ট্রীয় সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। ক্ষমতার বৈধতা, সাংবিধানিক পথ ও জনগণের ম্যান্ডেট- সব প্রশ্ন এখন ঝুলে আছে এক অজানা পরিণতির অপেক্ষায়। আগামী দুদিনেই হয়তো নির্ধারিত হবে, দেশ যাচ্ছে গণভোটের পথে নাকি একতরফা নির্বাচনের দিকে।
জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ ছিল জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি পরিণত হয়েছে তীব্র মতবিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিরোধীরা বলছে, গণভোট ছাড়া নির্বাচন মানে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা, আর সরকার বলছে, অতিরিক্ত বিলম্ব মানে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া। এ দ্বন্দ্ব এখন পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে থমকে দিয়েছে।
রাজধানীর পল্টনে মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান হুঁশিয়ারি দেন, যারা জুলাই বিপ্লব মানবেন না, তাদের জন্য ২০২৬ সালে কোনো নির্বাচন নেই। তার কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো ভোট নয়। তিনি বলেন, গণভোটের ব্যাপারে সবাই একমত, তাহলে তারিখ নিয়ে বায়নাবাজি কেন? তার দাবি, গণভোটেই তৈরি হবে আইনি পাটাতন, আর সেটির ওপর দাঁড়িয়েই হবে জাতীয় নির্বাচন।
জামায়াত এখন সনদকে ‘বিপ্লবের দাবি’ হিসেবে দেখছে। শফিকুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদের দাবির কাছে জনগণ মাথা নত করবে না। তার ভাষায়, ‘আমরা ভদ্র ভাষায় কথা বলব, কিন্তু দাবিতে হিমালয়ের মতো অনড় থাকব।’
অন্যদিকে বিএনপির অবস্থান খানিক ভিন্ন হলেও সুর একই রকম কঠোর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই সনদের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দায় সরকারের। তার অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টা বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে ঐকমত্যের সিদ্ধান্তকে দুর্বল করতে চাইছেন। বিএনপি এখনো সনদে অটল, তবে তারা চায় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক। সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা ঐকমত্যে রাজি হয়েছি-একদিনেই নির্বাচন ও গণভোট হোক।’
তবে তিনি কঠোরভাবে বলেন, রাষ্ট্রপতির আদেশ দিয়ে আইন তৈরি করা এখন সংবিধানবিরোধী। প্রেসিডেন্ট অর্ডারের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, সরকার যদি রাষ্ট্রপতির নামে কোনো সিদ্ধান্ত জারি করে, বিএনপি সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করবে।
সরকারি শিবিরে এখন সময়ের হিসাব চলছে মিনিটে মিনিটে। জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, দলগুলো সময় পেয়েছে, এখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দরজা খোলা আছে, কিন্তু নতুন আলোচনার আমন্ত্রণ নেই। সব ইঙ্গিত বলছে, বৃহস্পতিবারই সরকার নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে- যা দেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে।
অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, এটি ‘একদলীয় নির্বাচন আয়োজনের নীলনকশা।’ বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই ইঙ্গিত দিয়েছে, সরকার একতরফা পথে গেলে তারা রাজপথে নেমে যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন দেশ এমন এক সূক্ষ্ম রেখায় দাঁড়িয়ে যেখানে একটি ভুল সিদ্ধান্ত পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছে, যারা জুলাই সনদ মানবে না, তাদের সঙ্গে কোনো জোট নয়। দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ আগুনসন্ত্রাসের রাজনীতি চালাচ্ছে এবং তাদের ‘রাজনৈতিক উপযোগিতা ফুরিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, গডফাদার রাজনীতি ও দুর্নীতি বন্ধ না করলে কোনো নির্বাচনেরই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না।
জাতীয় পার্টি (জাপা) আপাতত কৌশলগত নিরপেক্ষতায়। তারা বিএনপি বা জামায়াত- যে পক্ষই নির্বাচনে টিকে থাকতে পারবে, সে দিকেই ঝুঁকবে বলে দলীয় সূত্র জানায়।
এদিকে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, যার বহু নেতা এখন বিদেশে বা আত্মগোপনে, ১৩ নভেম্বর ‘লকডাউন কর্মসূচি’ ঘোষণা করেছে। তাদের দাবি, এটি ‘অরাজকতা প্রতিরোধের কর্মসূচি’, কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এ পদক্ষেপ রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল ছাড়া কিছু নয়।
রাজনীতির প্রতিটি পক্ষ এখন যেন শেষ বাজিটি খেলছে। সরকার চাইছে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে, আর বিরোধীরা বলছে, গণভোট ছাড়া নির্বাচন মানে গণতন্ত্রের মৃত্যু। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সরকারের সিদ্ধান্তই ঠিক করবে, বাংলাদেশ যাচ্ছে কি না এক নতুন সংঘাতের দিকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই সনদ একসময় ঐক্যের প্রতীক ছিল, এখন সেটিই বিভেদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকার যদি একতরফা পথে হাঁটে, দেশ প্রবেশ করতে পারে অস্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায়ে। আর যদি গণভোটে যায়, নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে পড়বে।
সব মিলিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ এখন টগবগ করছে। রাস্তায় নেমে আসার হুমকি, একতরফা সিদ্ধান্তের প্রস্তুতি, আর অনিশ্চিত নির্বাচন—সবকিছুর মাঝেই আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা মোড়ে। সামনের দুদিনেই নির্ধারিত হবে- দেশ যাচ্ছে আপসের পথে, নাকি মুখোমুখি সংঘর্ষের দিকে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































