Apan Desh | আপন দেশ

জীবনের দূর্বীসহ বেদনা ভুলে স্থায়ী ঠিকানা চায় শরনার্থীরা

মো. রাফাসান আলম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ২০ জুন ২০২৫

জীবনের দূর্বীসহ বেদনা ভুলে স্থায়ী ঠিকানা চায় শরনার্থীরা

ফাইল ছবি

আজ ২০ জুন, আন্তর্জাতিক শরনার্থী দিবস। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে এ দিনটি পালিত হয় নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে। দিনটি মোটেও প্রশান্তির বার্তা কিংবা স্নিগ্ধতার হাসি ফোটায় না। জানান দেয় থমকে যাওয়া জীবনের দূর্বীসহ বেদনার কথা। বোমা আর বারুদের গন্ধে পরিচিত উঠোন অচেনা হয়ে ওঠা, বাড়িঘর পুড়ে ছাই হওয়া, নিজেদের থেকে বের করে দেয়া কিংবা জীবন বাঁচাতে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে পোহানো বিস্বাদময় জীবনযাত্রা। এসব শরনার্থীরা ঘরে ফিরতে চায়, নিরাপদ আবাসস্থল ও মৌলিক চাহিদা ফিরে পেতে চায়। 

এ মানুষগুলো কোনো অপরাধী নয়; তারা শুধুই যুদ্ধ, নিপীড়ন, জাতিগত বিদ্বেষ কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নির্মম শিকার। তাদের গল্পগুলো যেন অশ্রু আর সংকল্পের এক মিশেল। যেখানে মা ক্ষুধার্ত সন্তানকে বাঁচাতে শুকনো বুকে দুধ না থাকা সত্ত্বেও কাঁদতে দেন না; শিশুর কাঁধে স্কুল ব্যাগ নয়, বয়ে চলে ত্রাণের ভার; আর তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছাও থাকে কেবল 'বাড়ি ফিরে যাওয়া'।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR-এর ২০২৪ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ১১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। এটি এমন এক ভয়াবহ পরিসংখ্যান যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে ভিনদেশের মাটিতে শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছেন।

বাকি ৭ কোটিরও বেশি মানুষ নিজ দেশেই উদ্বাস্তু, যাদের মাথার ওপর ছাদ আছে, কিন্তু নেই 'ঘর' নামক আপন আশ্রয়। এ সংখ্যাগুলো নিছকই কিছু ডেটা নয়, প্রতিটি সংখ্যা একজন মানুষের হারানো স্বপ্ন, ছিন্ন হওয়া সম্পর্ক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।

শরণার্থী: বিবিধ পরিচয়, একই যন্ত্রণা
শরণার্থী শব্দটি কেবল একটি পরিসংখ্যান বা একটি রাজনৈতিক পরিচয় নয়; এটি এক অনিবার্য যন্ত্রণার নাম, এক হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের এ বিশাল সংখ্যাকে বুঝতে হলে তাদের বিবিধ পরিচয় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি:

শরণার্থী (Refugee): ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন অনুযায়ী এরা এমন ব্যক্তি, যারা জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা, বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নিপীড়নের সুনির্দিষ্ট ভয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয় এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষা লাভ করে। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া জীবন ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি (Internally Displaced Person- IDP): এরা নিজ দেশের অভ্যন্তরেই সংঘাত, সহিংসতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে না। বিশ্বজুড়ে IDP দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং তাদের সুরক্ষা ও সহায়তা প্রায়শই অপ্রতুল থাকে, যা তাদের পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে।

আশ্রয়প্রার্থী (Asylum Seeker): যে ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে প্রবেশ করে শরণার্থীর মর্যাদা লাভের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করে, কিন্তু তার আবেদন প্রক্রিয়াধীন থাকে। এই প্রক্রিয়া কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে, এ সময়ে তাদের জীবন চরম অনিশ্চয়তায় কাটে।

রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি (Stateless Person): যাদের কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেই এবং কোনো দেশের আইনি সুরক্ষা পায় না। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান এবং চলাফেরার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ অভিশপ্ত পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছেন।

জলবায়ু শরণার্থী (Climate Refugee/Migrant): যদিও আইনগতভাবে এখনো স্বীকৃত নয়, এরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি) এর কারণে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। এদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এটি অন্যতম প্রধান মানবিক সংকটে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবলে বাস্তুচ্যুত মানুষ: এক নীরব বিপর্যয়
যুদ্ধ বা সংঘাত ছাড়াও এক নীরব অথচ বিধ্বংসী সংকট বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। আর তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভয়াবহ খরা, আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ক্রমশ আরও তীব্র হয়ে উঠছে, যা লাখ লাখ মানুষকে তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য করছে।

যদিও আন্তর্জাতিক আইনে 'জলবায়ু শরণার্থী'র এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুতির এক নির্মম বাস্তবতা, যাদের জীবনও যুদ্ধ বা সংঘাতের শিকার মানুষদের মতোই অনিশ্চিত। তাদের গল্পগুলো প্রায়শই অনুচ্চারিত থেকে যায়, অথচ তাদের সংগ্রাম প্রতিদিনের।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি, এক প্রলম্বিত বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং নিচু ভূমির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধিও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৯৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। অর্থাৎ, প্রায় দুই কোটি মানুষ তাদের জন্মভূমি হারাবে, যা একটি দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ। ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরা এখানকার উপকূলীয় এবং নদী অববাহিকার লাখ লাখ মানুষকে গৃহহীন করেছে। ২০২২ সালেই ৭.১ মিলিয়নের বেশি বাংলাদেশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা।

অনেক মানুষ গ্রামের ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর মতো বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এটি শহুরে সম্পদের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এক নতুন ধরনের সামাজিক সংকট তৈরি করছে। শুধু মানুষের জীবন-জীবিকা নয়, দীর্ঘদিনের সামাজিক বন্ধন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে এ বাস্তুচ্যুতি।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশগুলো, যেমন: সোমালিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া, নাইজার, মালি, চাদ এবং দক্ষিণ সুদান ভয়াবহ খরা, মরুকরণ ও বন্যার কারণে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছে। এ অঞ্চলগুলোতে খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা সংঘাতের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অন্যদিকে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো যেমন তুভালু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, কিরিবাতি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হয়তো নিজ দেশ বলতে কিছু থাকবে না, যা এক গভীর মানবিক ট্রাজেডি। এশিয়াতে চীন, ফিলিপাইন, ভারত ও পাকিস্তানও বন্যা, টাইফুন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিপুল সংখ্যক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার। এ দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সবচেয়ে কম অবদান রাখলেও, এর মারাত্মক পরিণতি সবচেয়ে বেশি তাদেরই বহন করতে হচ্ছে, যা বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে ধরে।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন: এক রক্তাক্ত স্মৃতির উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের জন্মগাঁথায় মিশে আছে শরণার্থীর এক নির্মম অভিজ্ঞতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের গণহত্যা শুরু করে, তখন প্রথম কয়েক সপ্তাহেই প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশী ভারতের দিকে পাড়ি জমান।

এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখে পৌঁছায়, যা ছিল মানব ইতিহাসের এককালীন সবচেয়ে বড় শরণার্থী স্রোত। এ এক কোটি বিশ লাখ মানুষ কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যা একজন মায়ের সন্তান, একজন স্ত্রীর স্বামী, একজন শিশুর বাবা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও বিহারের সীমান্তজুড়ে গড়ে ওঠে অগণিত অস্থায়ী শিবির। যার বিস্তৃতি ছিল আগরতলা থেকে ধর্মনগর, বনগাঁ থেকে বসিরহাট, আর নদিয়া থেকে কিষাণগঞ্জ পর্যন্ত। UNICEF ও CARE এর সহায়তায় সামান্য পানি ও ওষুধের ব্যবস্থা হলেও, খাদ্যের তীব্র অভাব, মহামারীর ভয় আর অনিশ্চয়তার কালো ছায়া ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।

অবশেষে আসে সে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এ শরণার্থীরা ফিরে আসেন এবং ইতিহাসে এ প্রথম একটি জাতি শরণার্থী থেকে স্বাধীন নাগরিক হয়ে ওঠার অনন্য নজির স্থাপন করে। এটি আমাদের জাতিসত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের মানবিকতা ও সহনশীলতার প্রতীক।

রোহিঙ্গা: নাগরিকত্বহীনতার এক জীবন্ত নরক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর চলে আসছে জাতিগত বৈষম্য ও অমানবিক নির্যাতন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নতুন করে অভিযান শুরু করে, যাকে জাতিসংঘ 'জাতিগত নির্মূল' (ethnic cleansing) বলে আখ্যায়িত করেছে।

মাত্র এক মাসে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন কাটাচ্ছেন এক নিদারুণ অনিশ্চয়তায়।

কুতুপালং ও বালুখালী এই শিবিরগুলো আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প। UNHCR এর তথ্যমতে, ২০২৪ সাল নাগাদ কুতুপালং শিবিরেই প্রায় ৬ লাখ মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসবাস করছে। ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া চললেও, তাদের সমস্যাগুলো কাটছে না।

এ মানুষগুলো নাগরিকত্বহীন, আয়হীন এবং ভবিষ্যৎহীন এক অথৈ সাগরে ভাসমান। তারা শুধুই টিকে আছে, কিন্তু 'জীবন' তাদের থেকে বহু দূরে। তাদের চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কেমন করে আশাগুলো প্রতিদিন মরে যাচ্ছে, আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভার তাদের কাঁধে চেপে বসে আছে।

ফিলিস্তিন: সাত দশকের অবিরাম কান্না
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের জীবনে নেমে আসে এক অন্তহীন দুঃখ গাঁথা। ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ৭০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন এবং আজও তারা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেননি।

গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়াজুড়ে ছড়িয়ে আছে UNRWA পরিচালিত ৫৮টি শরণার্থী শিবির, যা তাদের চিরন্তন বেদনার নীরব সাক্ষী। প্রতিটি শিবির যেন এক একটি স্মৃতিসৌধ, যা হারানো বাড়ির গল্প বলে।

গাজার জাবালিয়া, বুরেজ, খান ইউনুস ও নুসাইরাত শিবিরগুলো ২০২৩-২৪ সালের ইসরায়েলি আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। মে ২০২৪ পর্যন্ত গাজায় ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকের বেশিই নারী ও শিশু। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছে এ শরণার্থী পরিচয়, যা তাদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। একটি শিশুর কাছে তার জন্মভূমি কেবল মানচিত্রের এক অংশ নয়, বরং অস্তিত্বের প্রতীক, যা বারবার তাদের মনে করিয়ে দেয় নিজ দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা।

আফগানিস্তান: যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের অন্তহীন ক্ষয়
আফগানিস্তান বহু দশক ধরে যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং তালেবান শাসনের কারণে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শরণার্থী উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। ২০২৫ সালেও এই করুণ প্রবণতা থেমে নেই। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNHCR এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৬ লাখ আফগান আজও আন্তর্জাতিক শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত।

এর মধ্যে ইরান ও পাকিস্তানেই রয়েছে সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি। পাকিস্তানে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ রেজিস্টার্ড আফগান শরণার্থী বসবাস করছে। পাকিস্তানের নাসির বাগ, কোয়েটা ও করাচি অঞ্চলের ক্যাম্পগুলো যেন একেকটি শরণার্থী শহর, যেখানে জন্ম নেয়া অনেক শিশু 'আফগানিস্তান' নামক দেশের অস্তিত্ব সম্পর্কেও অবগত নয়।

২০২৩ সালের পর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করার নীতির ফলে শুধু পাকিস্তান থেকেই ৯ লাখেরও বেশি আফগানকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইরানে অবস্থানকারী আফগানদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ, যাদের মধ্যে অনেকেই অনিবন্ধিত অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে।

দেশটি মাঝে মাঝেই বাধ্যতামূলক প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দিয়ে থাকে, যা শরণার্থীদের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তোলে। নিজ দেশে ফিরেও নিরাপত্তা, খাদ্য সংকট এবং নারীশিক্ষার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার মতো পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে আফগানিস্তানের ৩২ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত (IDP)। তাদের ভবিষ্যৎ যেন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে আছে, যেখানে আশার আলো ক্ষীণ।

সিরিয়া ও সুদান: গৃহযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০১১ সালে এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত এতে অন্তত ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আর ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তুরস্কের কিলিস ও হাটে শহর, লেবাননের বেকা উপত্যকা এবং জর্ডানের জাতারি শিবির মিলিয়ে এখনো ৬০ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে।

অন্যদিকে, সুদানে ২০২৩ সালে সেনাবাহিনী ও RSF এর মধ্যে শুরু হওয়া ভয়াবহ সংঘর্ষে ২০২৪ সালের মধ্যে ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। চাদ, দক্ষিণ সুদান ও মিশরের সীমান্তে তৈরি শরণার্থী শিবিরগুলোতে নেই পর্যাপ্ত খাদ্য, নেই ন্যূনতম চিকিৎসা।

শুধু বেঁচে থাকার এক কঠিন সংগ্রাম সেখানে প্রতিনিয়ত চলছে, যেখানে প্রতিদিন নতুন করে তৈরি হচ্ছে মানবিক বিপর্যয়ের গল্প। এ সংঘাতগুলো কেবল দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভিটেমাটি হারানো মানুষের স্বপ্ন: এক মানবিক আবেদন
বাংলাদেশ যেমন ১৯৭১ সালে শরণার্থীর দুঃসহ বাস্তবতা নিজের চোখে দেখেছে, তেমনি আজ বিশ্ববাস্তবতায় আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে রোহিঙ্গাদের মতো এক দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকট। ফিলিস্তিন থেকে আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে সুদান, প্রতিটি শরণার্থী শিবির এক একটি চলমান যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন, এক নীরব আর্তনাদ। এ পরিস্থিতিগুলো কেবল মানবিক দুর্যোগ নয়, সভ্যতারও এক কঠিন পরীক্ষা।

আমরা যদি সত্যিই শান্তির পৃথিবীকে বিশ্বাস করি, তাহলে শরণার্থী সমস্যাকে আর কেবল 'সাহায্যের বিষয়' হিসেবে নয়, মানবাধিকার ও ন্যায়ের মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে দেখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নতুন এবং ভয়াবহ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

কেবলমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নয়, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ এক্ষেত্রে অপরিহার্য। রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের উচিত এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা, যেখানে কেউ নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য না হয়।

কারণ, একমাত্র তখনই এ পৃথিবী সত্যিকার অর্থে সকল মানুষের বাসযোগ্য হবে, না শরণার্থী হিসেবে, না উদ্বাস্তু হিসেবে বরং নিজভূমিতে নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার মতো একটিমাত্র পরিচয়ে। এ স্বপ্ন পূরণ হোক, এটাই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা।

 আপন দেশ/জেডআই

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়