ফাইল ছবি
সব লেখকই চোর। কেউ অকপটে কবুল করে, কেউ মুখে কালি লাগিয়ে ঘরোয়াভাবে চুরি করে যায়। নাইনা বডেন যখন গম্ভীর মুখে বললেন, "All writers are thieves" তখন পাশে বসে থাকা এক পাঠক চুপচাপ নিজের ওয়ালেট দেখলেন, ঠিকঠাক আছে তো? কারণ সত্যিই, লেখালেখির জগৎটা আসলে ঠকাঠকির এলাকা। কলমে ছুরি বসানো থাকে, শুধু রক্ত বেরোয় না, বেরোয় ছাপা অক্ষর।
দেখুন, ‘Da Vinci Code’-এর ড্যান ব্রাউনও ভাবছিলেন, "আমি তো শুধু একটা রহস্য উপন্যাস লিখেছি, তাও প্রায় বাইবেল ঘেঁটে!" কিন্তু লন্ডনের আদালত বলল, "ভাই, এ তো আমাদের পুরোনো স্ক্রিপ্টের পুনর্জন্ম!" মামলা উঠল, মামলা চলল, আদালত ঘামল। শেষে খ্যাপার মতো টাকা খরচ করে ড্যান বেঁচে ফিরলেন, যেমন ক্যাথলিক গির্জা ফুঁপিয়ে ওঠে ‘ইভিল’ চিহ্ন দেখে। আর একদিকে, জে. কে. রাউলিং, যিনি এক হাতে পুরো ব্রিটিশ শিশুদের ফের বই পড়াতে শুরু করলেন, তিনিও ৭ বছর ধরে লড়াই করলেন 'Goblet of Fire' নাকি আগেই কেউ পান করে ফেলেছে এই অভিযোগ নিয়ে। তাই কখনও কখনও লেখকের কলমে কালি নয়, আদালতের রায় পড়ে।
আরও পড়ুন<<>>ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা হলে কঠোর ব্যবস্থা: প্রেস সচিব
আলেক্স হেলি বলেছিলেন, আমার পূর্বপুরুষ কুন্টা কিন্টে। আফ্রিকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওর নাতির নাতির নাতি আমি। ‘Roots’–এর এ নস্টালজিয়া মাখা ন্যারেটিভ এতটাই মোক্ষম ছিল যে আমেরিকার আফ্রো-হেরিটেজ গর্বে ভরপুর হয়ে উঠল। বই বিক্রি হলো, টিভি সিরিজ হইহই করল। তারপর এলেন হ্যারল্ড কোরল্যান্ডার। হাতে একটি আগের উপন্যাস ‘The African’, মুখে অভিযোগ, হেলি, তুমি আমার গল্পটা গিলে ফেলেছ। মামলা চলল, শেষে আদালতের বাইরে সেটেলমেন্ট। টাকা দিলেন হেলি। তবে ততদিনে বইয়ের পাতাগুলো আমেরিকার কালো পাঠকদের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
স্যার থমাস ম্যালরি, যাকে ‘Le Morte d’Arthur’-এর লেখক ধরা হয়, তিনি মধ্যযুগের চোর-ডাকাত-ফাঁকিবাজদের আইকন হয়ে উঠলেন। খোদ রাজপালের ঘাড় মটকে দেয়া এ শিবিরের লোক। গোটা আর্থারিয়ান লেজেন্ড ছিনতাই করে নিজের বানালেন, আর নিজে একবার গ্রেফতার, একবার পালালেন, কখনও ঘোড়া চুরি, কখনও প্রেমঘটিত ধর্ষণ। ভাবুন, যে লিখেছেন সাহস, ভদ্রতা, প্রেম—তিনি নিজে হাঁটছেন আদালতের পথে।
পল ভার্লেন ও আর্তুর র্যাঁবো দুজনেই কবি, দুজনেই মাতাল, আর দুজনেই একে অপরের প্রেমে বুঁদ। প্রেমের তীব্রতা এতটাই যে একবার ব্রাসেলসে গিয়ে ঝগড়ার পরে ভার্লেন র্যাঁবোর বাহুতে গুলি চালালেন—কবিতার বদলে বন্দুক! ভার্লেন দুবছরের জেল খাটলেন, র্যাঁবো চলে গেলেন মরক্কো, পা কেটে, মরলেন ৩৭-এ। আর প্রেমের বন্দুক ২০১৬-তে বিকোয় ৪৩৪,৫০০ ইউরোতে। প্রেম পোষায়, আর পকেটও ভরায়।
ক্যারোয়াক, গিন্সবার্গ, বুরোজ, গ্রেগরি কোরসো—সবাই সাহিত্যিক, আবার সবাই পুলিশ স্টেশনের পরিচিত মুখ। কেউ প্রেমিকার বাড়িতে বিয়ে করতে রাজি হয়ে জামিন পেলেন, কেউ নিজের ঘরে চোরাই মাল রেখে জেলে গেলেন। কোরসো তো ক্লিনটন স্টেট জেলে ৩ বছর কাটিয়েই কবিতা লেখার স্বাদ পেলেন। ভাগ্যিস ‘লাকি’ লুসিয়ানোর সেল ফাঁকা ছিল। আর বুরোজ? নিজের প্রেমিকাকে গুলি করে মেরে বললেন, ওই ঘটনাই আমাকে লেখক বানিয়েছে। ভাবুন, লেখার প্রেরণা যদি স্ত্রীর মাথা খেয়ে আসে, তাহলে লাইনের নিচে সাদা কালি কেন রক্তের মতো লাগে বুঝতে বাকি থাকে না।
হেনরি ডেভিড থরো যিনি একটানা ২ বছর ২ মাস ২ দিন একা ছিলেন, আসলে প্রতিদিন মায়ের কাছে জামাকাপড় ধুয়ে আনাতেন। কিন্তু যখন ‘পোল ট্যাক্স’ দিতে অস্বীকার করলেন, জেলে গেলেন। একরাত্রির এই বন্দিত্ব থেকে জন্ম নেয় ‘Civil Disobedience’—যা গান্ধী থেকে মার্টিন লুথার কিং পর্যন্ত ভরসা করলেন। কাপড় ধোয়া আর পৃথিবী ধোয়া, দুটোই পরিবার থেকে শুরু হয়।
Francois Villon—Sorbonne থেকে মাস্টারস, তারপর খুন-ডাকাতি-জেল। একবার যাজককে ছুরি মেরে পালালেন। আবার ৫০০ গোল্ড ক্রাউন চুরি করে রেসিডেন্স বদলালেন। মৃত্যুদণ্ডের মুখে দাঁড়িয়ে ‘Ballad of the Hanged Men’ লিখলেন, তারপর ভাগ্য বদলে ১০ বছরের নির্বাসন। সেই যে গেলেন, আর এলেন না। ফরাসি কবিতার সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি অপরাধতত্ত্বও রোমাঞ্চ পেল।
ফ্রান্সে যুদ্ধবিরোধী চিঠি লেখার অপরাধে কবি ই. ই. কামিংস জেলে গেলেন। গোটা চার মাস। তারপর সেই অভিজ্ঞতাই পরিণত হলো ‘The Enormous Room’-এ। মানে, জেলখানাই হয়ে গেল কাব্যিক অনুপ্রেরণার ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’।
লেখকরা চুরি করে না, তারা ‘inspired’ হন। কেউ লেখার ছলে প্রেমিকাকে খুন করেন, কেউ প্রেমে পড়ে দেশভাগ করেন, কেউ বন্দুকের দুনিয়ায় সত্যি মেনে নেন পাগলামিকেই। আর আপনি যদি এখনও ভাবছেন লেখকদের জীবন পবিত্র—তবে বলি, সাহিত্য আসলে সাদা কাগজে লেখা অন্ধকার ফাইল।
পুনশ্চ: এই লেখায় যদি কারও গন্ধ পাওয়া যায়, তবে ধরে নেবেন, আপনার নাকটা একটু বেশি সেনসিটিভ।
আপন দেশ/এসআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































