
সংগৃহীত ছবি
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি দেন।
প্রথমে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এ প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর এ বৈঠকের এক সপ্তাহ আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আটটি আরব ও মুসলিম দেশের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তারা মোট ২১টি দফা নিয়ে আলোচনা করেন সে বৈঠকের পর আরব নেতারা ধারণা করেছিলেন যে গাজার যুদ্ধ বন্ধ হবে।
নেতানিয়াহুর পরিবর্তন
তবে আরব ও ইসলামিক নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্প যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন, নেতানিয়াহু সেগুলোতে বড় পরিবর্তন এনেছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে সোমবারের বৈঠকের ঠিক আগে শেষ মুহূর্তে তিনি এ পরিবর্তনগুলো আনেন।
এ পরিবর্তনের কারণে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্ডান ও কাতারসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো ক্ষুব্ধ হয়েছে। এ তথ্য বুধবার (০১ অক্টোবর) একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর।
আরব আলোচকদের দুটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে নিশ্চিত করেছে। তারা বলেছেন, হামাসকে যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের খসড়া দেয়া হয়েছে, তা আরব-মুসলিম নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি ট্রাম্পের খসড়ার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন।
তারা আরও বলেন, প্রথমে এটি ছিল একটি যৌথ প্রচেষ্টা। কিন্তু এখন ইসরায়েল এ বিষয়টিকে 'শান্তির' পরিবর্তে শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপত্তার টুল হিসেবে ব্যবহার করছে।
মূল পরিবর্তন: সেনা প্রত্যাহার ও শর্ত
নেতানিয়াহু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি এনেছেন, সেটি হলো ইসরায়েলি সেনাদের গাজা থেকে প্রত্যাহার করার শর্ত। সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে নেতানিয়াহু কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এছাড়া প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট সময়সীমাও উল্লেখ করা হয়নি।
বর্তমানে যে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহারকে সম্পূর্ণভাবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এর মানে হলো, হামাস নিজেদের নিরস্ত্রীকরণ না করলে, ইসরায়েল গাজা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করবে না।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওস-কে যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়ে হামাস কোনো পরিবর্তন চাইলে, সেটি বিবেচনা করা হতে পারে। তবে এ প্রস্তাবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা: জল্পনা ও বাস্তবতা
গাজার পরিস্থিতি এখন এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফার একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। এ পরিকল্পনার লক্ষ্য গাজা যুদ্ধের অবসান। তবে গাজাকে যেভাবে সাজানো বা পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
মানবিক বিপর্যয় ও মৃত্যুর হিসাব
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের আজ ৭২৪তম দিনে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। এটি এ শতাব্দীর সবচেয়ে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়। এ সংখ্যা কেবল বোমা হামলায় বা গুলিতে সরাসরি নিহতদের।
বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এর গবেষণা বলছে, সরাসরি আঘাতের কারণে সরকারি হিসাবে যে মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয়, তা মোট প্রাণহানির মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি একজন সরাসরি মৃতের বিপরীতে আরও চারজন মারা যাচ্ছেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা বা বিনা চিকিৎসায়।
এভাবে হিসাব করলে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা তিন লাখের অধিক হতে পারে। এটি চলমান আগ্রাসন শুরুর দিকের গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-অষ্টমাংশ।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার শর্তাবলী
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় যেসব বিষয় বলা হয়েছে:
-
গাজা হবে একটি নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল। এটি প্রতিবেশীদের জন্য কোনো হুমকি হবে না।
-
গাজাকে পুনর্গঠন করা হবে।
-
ইসরায়েল ও গাজার প্রতিনিধিরা সম্মত হলে হামলা অবিলম্বে বন্ধ হবে।
-
ইসরায়েল তাদের সেনা প্রত্যাহার করবে।
-
বন্দি মুক্তির প্রস্তুতি চলবে। এ সময়ে সব সামরিক অভিযান বন্ধ থাকবে।
-
৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দি (জীবিত ও মৃত) ফেরত দেয়া হবে।
-
সব বন্দি মুক্ত হলে ইসরায়েল প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে।
-
হামাস সদস্যদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অস্ত্র ত্যাগ করার শর্তে দায়মুক্তি দেয়া হবে।
-
চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে গাজায় অবিলম্বে ত্রাণ ও রসদ পাঠানো হবে।
-
রাফাহ সীমান্ত খুলে দেয়া হবে।
-
গাজা একটি টেকনোক্রেটিক ও অরাজনৈতিক কমিটি দ্বারা শাসিত হবে। এ কমিটি নিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হবে।
-
এ কাজের তদারকি করবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অস্থায়ী সংস্থা, যার নাম ‘বোর্ড অব পিস’।
-
গাজায় সব সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হবে। পুনর্নির্মাণ করা হবে না।
-
ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) গঠন করা হবে। আইএসএফ ফিলিস্তিনি পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে। নিরাপত্তা বজায় রাখবে।
-
ইসরায়েল গাজা দখল করবে না। আইএসএফ গাজায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে, ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সরে যাবে।
-
ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরি করা হবে। যদি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের সংস্কার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।
জটিলতা ও অনিশ্চয়তা
এ পরিকল্পনাকে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পাকিস্তান, তুরস্ক ও আরব উপসাগরীয় দেশগুলো সমর্থন জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও একে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু গাজার মূল শক্তি হামাস এখনো সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে হুমকি দিয়েছেন যে, এ প্রস্তাব হামাস মেনে না নিলে, গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
সুস্পষ্টভাবেই, এ চুক্তিতে একমত হওয়া হামাসের জন্য একপ্রকার আত্মসমর্পণ। আবার নেতানিয়াহুর জন্যও এটি একপ্রকার রাজনৈতিক পরাজয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন।
তবে আন্তর্জাতিক রীতি ও আইনকে উপেক্ষা করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের। এ চুক্তি বাস্তবায়নে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইএসএফ) গঠনের প্রশ্ন আছে। টেকনোক্র্যাট শাসন বোর্ড ও টনি ব্লেয়ারের ভূমিকা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে।
ফলে শেষ পর্যন্ত এ ঘোষণা ফিলিস্তিনে শান্তি আনতে কতখানি ভূমিকা রাখবে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।