Apan Desh | আপন দেশ

ফারুক আহমেদের অপসারণ, ষড়যন্ত্র না ক্যু?

ক্রীড়া প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ১ জুন ২০২৫

ফারুক আহমেদের অপসারণ, ষড়যন্ত্র না ক্যু?

ফারুক আহমেদ

ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদকেও একজন ভদ্রলোক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তার ক্রিকেট মস্তিষ্ক খুবই পরিপক্ষ এবং স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। সাবেক এ ক্রিকেটারকে যারা চিনেন, তারা এক বাক্যে বলবেন তিনি একজন সৎ মানুষ। যার প্রমাণ মিলেছে তিনি যখন জাতীয় দল নির্বাচক প্যানেলের প্রধান ছিলেন। কাজে অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে লাখ টাকা সম্মানীর চাকরি এক নিমেষেই ছুঁরে ফেরেছিলেন ফারুক আহমেদ। এমন সততার কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতির চেয়ারে বসানো হয়েছিল তাকে।

গত বছরের জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। জনরোষে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ফারুক আহমেদকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু মাত্র ৯ মাসের মাথায় অপমানিত হয়ে বিদায় নিয়ে হলো জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ককে। 

কী এমন ঘটলো যে, বছর না ঘুরতেই সরে যেতে হলো ফারুক আহমেদকে। ৭২ ঘন্টার উত্তেজনাময় নাটকীয়তার পর শেষ হয়ে গেল ফারুক আহমেদের বিসিবি অধ্যায়। সত্যি কি সো্জা ছিল এ বিদায়? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে ছিল ষড়যন্ত্র, আস্থা-অনাস্থার মুখোশের আড়ালে রচিত এক ‘ক্রিকেটীয় ক্যু’?

দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন নাটকীয়তা খুব কমই দেখা গেছে অতিতে। একদিকে আট পরিচালকের দেয়া অনাস্থা পত্র। অন্যদিকে বিসিবির অভ্যন্তরীণ নথি, যা সে অভিযোগকে উল্টো দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক রকমের বোমার মতো চমকে। দুর্নীতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বহু হিসেব নিকেষ জড়িত এ ঘটনার পিছনে।

বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসন ভর করেছিল বিসিবিতেও। সেখানে পরিচালকের চেয়ারে বসে অনেকে নিজের ফায়দা হাসিল করেছেন। আদায় করে নিয়েছেন নানা অবৈধ সুবিধাও। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলেও এখনও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন বেশিরভাগ বোর্ড পরিচালক। স্বৈরাচারের এসব দোসরদের কুটচালে ধরাশীয় হয়ে বিদায় নিতে হলো ফারুক আহমেদকে। 

সভাপতি হিসেবে গত ২১ অগাস্ট তিনি যখন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। তখন সব পরিচালক তাকে বাহবা দিয়েছিলেন। ৯ মাস পেরুতেই তিনি হয়ে পড়েন একা। তার পাশে তো কেউ ছিলই না, বরং শুরুতে পাশে থাকা ওই মানুষগুলিই এখন তাকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। সেখানে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং শাস্তি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার বছর না ঘুরতেই তাকেফারুক আহমেদ সভাপতির পদ হারাতে হয়েছে।

মাহবুব আনাম বিসিবি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন দুই যুগের বেশি সময় ধরে। বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তনে গোটা বোর্ডের চেহারা বদলে গেছে। কিন্তু তিনি কোনো না কোনোভাবে রয়েই গেছেন। আকরাম খান, কাজী ইনাম আহমেদের মতো কেউ কেউ নাজমুল হাসান পাপন সভাপতি থাকার তিন মেয়াদেই বা দুই মেয়াদে বোর্ড পরিচালক ছিলেন ও আছেন। ফাহিম সিনহা, ইফতেখার রহমানরা পরিচালক হয়েছেন পরে, তবেও তারা ছিলেন নাজমুলের নেতৃত্বে বোর্ডে।

বছরের পর বছর ধরে তারা বিসিবিতে নানা ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু তাদের ঘিরে বিতর্ক-অভিযোগের শেষ নেই। পুরোনো ‘জঞ্জাল’ সঙ্গী করে নতুন পথে ছুটতে চাইলে তো এ পথও একই পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। ফারুক আহমেদ এখন যেমন বুঝতে পারছেন!

ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বিসিবির ৯ পরিচালকের ৮ জনই। কেবল আকরাম খান সেখানে স্বাক্ষর করেননি। মজার ব্যাপার হলো, চিঠিতে যেসব অভিযোগ তারা করেছেন, প্রায় সবকটি অভিযোগ নানা সময়ে উঠেছে আকরামসহ তাদের সবার বিরুদ্ধেই! বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে নিয়ে চলে আসছে অসংখ্য বিতর্ক। সংবাদ সম্মেলনে তাদেরকে নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন, সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তারা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।

এ ৯ মাসে ফারুক ভুল বা বাড়াবাড়ি করেননি, এমন নয়। অভিযোগের জায়গাও অনেক আছে। কিন্তু যেভাবে তাকে সরানো হলো, সেখানে 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' ছাপ একরকম প্রকাশ্যই। বিশেষ করে অনাস্থা চিঠিতে পরিচালকরা যা তুলে ধরেছেন, সেটিই আরও নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলছে তাদের গোপন কোনো উদ্দেশ্য।

চিঠিতে এমন কিছু অভিযোগ তারা করেছেন, যেগুলো তিন দফায় দায়িত্বে থাকা নাজমুল হাসানকে নিয়েও ছিল এবং প্রবলভাবেই সেসবের প্রকাশ দেখা গেছে। যথারীতি সংবাদমাধ্যম তখনও প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এ পরিচালকদের কেউ অনাস্থা জ্ঞাপন করা তো দূরের কথা, কোনোরকম প্রতিবাদ বা বাধা দেয়া কিংবা নিদেনপক্ষে অসমর্থন করেছেন, এমন কোনো নমুনা কখনও দেখা যায়নি, শোনাও যায়নি।

কাজেই দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে বা ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তারা জোট বেঁধে ফারুককে বিদায় করেছেন, এমন কিছু কল্পনা করাও কঠিন। বরং এখানে স্বার্থের সংঘাত বা নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণের পথে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিই বেশি উপযুক্ত মনে হয়।

এর ফলে বিসিবির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্যে এল। কেননা, এটি কেবল একজন সভাপতির অপসারণ নয় বরং বোর্ডের নীতি, স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘সফট কু’! 

এ ঘটনায় ক্রিকেটপাড়া হতবাক, বিস্মিত, কেউ কেউ উল্লসিত। তবে কেনো এত তাড়াহুড়ো? কেনো মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরাতে হলো ফারুককে? 

যদিও যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফারুকের অপসারণ সম্পর্কে বলেছেন, তার সরে যাওয়াটা একান্তই পারফরম্যান্সভিত্তিক। একজন ফর্মহীন খেলোয়াড়কে যেমন নির্বাচকরা দলে রাখবেন না, এ ব্যাপারটাও ঠিক তাই।

ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, যেটা হয়েছে সেটা শাস্তি বা অন্য কিছু নয়। বিসিবির নতুন নেতৃত্বের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। এ সরকার আসার পর প্রথম পাকিস্তানে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজি জিতেছে বাংলাদেশ। তারপর থেকে পারফরম্যান্সের অবনতি হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা যা করেছি তা পারফরম্যান্সের বিচারেই।

তিনি বলেন, সবশেষ বিপিএলে দুর্বার রাজশাহী দলের খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ও টিম হোটেল ইস্যু সরকার পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এ সরকারের জন্য বিষয়টি ছিল বিব্রতকর। বিপিএল ফাইনালে সরকার প্রধানের উপস্থিত থাকার কথা ছিল; কিন্তু তাকে আনতে পারিনি। এটা লজ্জাজনক। বিপিএলে অনেক অনিয়ম ও অবহেলা ছিল, যেগুলো আপনারাই রিপোর্ট করেছেন। এগুলোর মধ্যে অনেক কিছুতেই ফারুকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ক্রিকেট টিম গেম; কিন্তু বিসিবিতে টিম হয়নি। বোর্ডে বাকি যারা আছেন তারা কেউই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না। ক্রমাবনতির এটাও বড় কারণ। বিসিবির পরিচালকদের অনাস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতি, সত্যানুসন্ধান রিপোর্ট সব কিছুর সম্মিলনেই এ মনোনয়ন প্রত্যাহার। কোনো দুর্নীতির প্রমাণ নয়, পারফরম্যান্সের কারণেই তাকে সরানো হয়েছে।

ক্রীড়া উপদেষ্টা জানান, ধারাবাহিকভাবে কোনো খেলোয়াড় ব্যর্থ হলে তাকে দলে রাখেন না নির্বাচকরা। তিনি বলেন, কোনো খেলোয়াড় যদি টানা ব্যর্থ হয়, তাহলে কি তাকে নির্বাচকরা দলে রাখবেন? এখানে সেটাই হয়েছে। আমিও যদি পারফর্ম করতে না পারি, আমাকেও সরে যেতে হবে। আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ক্রিকেটকে তো ডুবে যেতে দিতে পারি না। যে আটজন পরিচালক ফারুক আহমেদের বিপক্ষে অনাস্থা এনেছেন তাদের মধ্যে সাতজন সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসানের সময়ও বোর্ডে ছিলেন। তবে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি আসিফ। তিনি জানান, ফারুক আহমেদকে সরানো অন্য ফেডারেশনগুলোর জন্যও একটি বার্তা।

তবে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে করেন আওয়ামী দোসর পরিচালকদের ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ শিকার হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে ফারুক আহমেদকে। জাতীয় দলের সাবেক একজন ক্রিকেটার হিসেবে এ অসম্মান মোটেও পাপ্য নয় তার। যদি তাকো কোনোভাবে না রাখা যেত তাহলে সম্মানের সহিত বিদায় করাই ছিল শ্রেয়।

আপন দেশ/জেডআই

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

Advertisement

জনপ্রিয়