
ফাইল ছবি
হজরত লুত (আ.)-কে এক রাতে তার পরিবারসহ অন্ধকারে এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়েছিল ও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল: ‘ওয়ালা তাল্তাফিত।’ অর্থাৎ, তোমাদের কেউ যেন পেছনে ফিরে না তাকায়, যেখানে যেতে বলা হয়েছে, সেখানে চলে যাও। (সুরা হুদ, আয়াত: ৮১)
এ নির্দেশের পেছনে রয়েছে গভীর তাৎপর্য: অতীতের দিকে তাকালে ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয়, আর এগিয়ে চললে মুক্তি ও সাফল্য অর্জিত হয়। ‘পেছনে ফিরে তাকিও না’—এ ঐশী নির্দেশ কেবল একটি ধর্মীয় বিধান নয়, বরং এটি জীবনের এক গভীর দর্শন, যা মানুষকে অতীতের শিকল থেকে মুক্ত করে এগিয়ে চলতে শেখায়।
এ আয়াতটি লুত (আ.)-এর ঘটনার প্রেক্ষাপটে এসেছে। যখন ফেরেশতারা তাকে জানিয়েছিলেন যে তার সম্প্রদায় ধ্বংস হতে চলেছে। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি যেন তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু তার স্ত্রী, যিনি পাপিষ্ঠদের সঙ্গে ছিলেন, তিনি ধ্বংসের শিকার হবেন।
এ নির্দেশকে কেবল আক্ষরিকভাবে বিবেচনা করলে চলবে না, বরং মানসিক ও আত্মিকভাবে অতীতের প্রতি আকর্ষণ ত্যাগ করারও আহবান ছিল এখানে।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, অতীতের প্রতি আকৃষ্ট থাকা—তা অনুশোচনা, অপরাধবোধ বা অতীতের জন্য অসুস্থ হাহাকার হোক—মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষণা বলছে, অতীতের স্মৃতিতে আটকে থাকা বিষণ্নতা ও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। (ড্যানিয়েল গোলম্যান, ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স, পৃ. ৬৭-৬৮, ব্লুমসবারি, লন্ডন, ১৯৯৬)
‘পেছনে ফিরে তাকিও না’ এখানে একটি নিরাময়কারী বার্তা। এটি বলে, অতীতের বেদনাকে বর্তমানে বয়ে বেড়ানো বন্ধ করো। এটি কঠোরতা নয় বরং প্রজ্ঞা। ক্ষমা করো, শিক্ষা নাও, কিন্তু অতীতের ক্ষতের মধ্যে বাস কোরো না। বর্তমানে বাঁচো।
অনেকে অতীতের ব্যর্থ সম্পর্কের কারণে নতুন সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হন। কেউ কেউ একটি পরীক্ষায় ফেল করার স্মৃতিতে আটকে থেকে শিক্ষাজীবন নষ্ট করেন। এমনকি জাতিও অতীতের দ্বন্দ্বে আটকে থেকে উন্নতির পথে এগোতে পারে না। ‘পেছনে ফিরে তাকিও না’—এই বাণী আমাদের শেখায়, অতীতকে স্বীকার করো, কিন্তু তাতে আটকে থেকো না। এগিয়ে চলো, কারণ সেখানেই মুক্তি।
প্রজন্মের জন্য শিক্ষা
শিক্ষায় এ নির্দেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ছোটবেলা থেকে শেখানো উচিত যে ভুল করা জীবনের শেষ নয়, বরং শিক্ষার একটি ধাপ। তাদের জন্য ‘পেছনে ফিরে তাকিও না’ আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার একটি মন্ত্র হতে পারে। যদি আমরা সন্তানদের অতীতের ভুলের জন্য লজ্জিত করি, তবে তারা সামনের দিকে এগোতে ভয় পাবে। তাদের শেখাতে হবে, অতীত একটি পাঠ, অভিশাপ নয়।
সামাজিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
ইতিহাসে এমন জাতির উদাহরণ রয়েছে, যারা পেছনে ফিরে না তাকানোর নীতি মেনে সাফল্য অর্জন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ধ্বংসের দিকে না তাকিয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছিল। ফলে তারা বিশ্বের শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়। একইভাবে, জার্মানি যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বিপরীতে যেসব জাতি অতীতের ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকে, তারা স্থবির হয়ে যায়। এ নীতি ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
নবীজির জীবন থেকে শিক্ষা
নবীজি (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করেন, তিনি বলেছিলেন: আল্লাহর কসম, তুমি (মক্কা) আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ভূমি, কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে বের করে না দিলে আমি চলে যেতাম না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৯২৮)
তবু তিনি পেছনে ফিরে তাকাননি। মদিনায় গিয়ে তিনি একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ ঘটনা আমাদের শেখায়, পেছনে তাকানো মিশনের পতন ডেকে আনতে পারে। আজকের ডিজিটাল যুগে, সামাজিক মাধ্যম আমাদের বারবার অতীতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ফটো, স্মৃতি, টাইমলাইনের নোটিফিকেশন—এসব আমাদের জোর করে পেছনে তাকাতে বাধ্য করে।
এমন হলে আমাদের মনে রাখতে হবে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার সম্প্রদায় ত্যাগ করে আল্লাহর পথে এগিয়ে যান। ইউসুফ (আ.) কারাগারের অন্ধকার থেকে মিসরের শাসনকর্তা হন, কারণ তিনি পেছনে ফিরে তাকাননি। মুসা (আ.) সমুদ্র বিদীর্ণ করেন, ফেরাউনের দিকে না তাকিয়ে। এ সব নবী সফল হয়েছেন, কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে এগিয়ে গেছেন।
‘পেছনে ফিরে তাকিও না’ একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বাক্য। এটি কেবল কোরআনের পাতায় আবদ্ধ না রেখে আমাদের সিদ্ধান্তে, সম্পর্কে ও জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে জীবন্ত করে তোলা উচিত। অতীতের ক্ষত, বিশ্বাসঘাতকতা বা ব্যর্থতার দিকে ফিরে তাকানোর কোনো অর্থ নেই।
আরবি প্রবাদে বলা হয়, যে পেছনে তাকায়, সে গন্তব্যে পৌঁছায় না। তাই, পেছনে ফিরে তাকিও না, যেখানে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সেদিকে এগিয়ে চলো।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।