
আপন দেশ
ইসলামের আগে তৎকালীন সমাজে নারীর অধিকার বলতে কোনো কিছুই ছিল না। উত্তরাধিকার, দেনমোহরের অধিকার কিংবা বিবাহ-তালাক, কোনো কিছুতে মতামত প্রদানেরও যেমন তাদের কোনো সুযোগ ছিল না, তদ্রূপ তাদের কোনো অধিকারও স্বীকৃত হতো না। মহানবি (সা.)-এর নবুওয়াতের পূর্বে জাহেলি সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এমনকি লোকজন তাদের কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত।
মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন নারীকে মা হিসেবে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া ইসলামে মা হিসেবে নারীকে যে উঁচু-মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে। অপর কোনো সম্মানের সঙ্গে তার তুলনাও হতে পারে না।
হজরত নবি করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, বেহেশত মায়ের পায়ের তলে অবস্থিত। অর্থাৎ মাকে যথাযোগ্য সম্মান দিলে, তার উপযুক্ত খিদমত করলে ও তার হক আদায় করলে সন্তান বেহেশত লাভ করতে পারে। অন্য কথায়, সন্তানদের বেহেশত লাভ মায়ের খেদমতের ওপর নির্ভরশীল। মায়ের খেদমত না করলে কিংবা মায়ের প্রতি কোনোরূপ খারাপ ব্যবহার করলে, মাকে কষ্ট ও দুঃখ দিলে সন্তান যত ইবাদত-বন্দেগি আর নেক কাজই করুক না কেন, তার পক্ষে বেহেশত লাভ করা সম্ভবপর হবে না।
মাকে ভালোবাসার জন্য কী কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষণের প্রয়োজন আছে? জীবনের প্রতিটি দিনই সন্তানের জন্য মা দিবস, প্রতিটিক্ষণই সন্তানের জন্য মা দিবস। তাই কোন নির্দিষ্ট দিনে মাকে স্মরণ করার শিক্ষা ইসলাম দেয় না। মায়ের জন্য ভালোবাসা চিরন্তন, অনাবিল। সবারই মায়ের পাশে থাকতেই মন উচাটন। পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াময় মুখ মায়ের। মা শব্দটিতে যে পরিমাণ ভালোবাসা মিশে আছে তা আর কোনো শব্দেই নেই।
বুক ফেটে যায় কান্নায় যখন দেখতে পাই প্রিয় মা-বাবাকে রেখে আসা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মা দিবস আসলে বছরে একবার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে গর্ভধারিণী মায়ের খোঁজ নেয় বা ফোনে ‘হাই-হ্যালো’ এ পর্যন্তই। আর অসহায় মা নীরবে বোবাকান্না কাঁদেন বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালে। অনাহারে অর্ধাহারে ভোগেন। কথা বলার মতো কেউ নেই।
কোন বৃদ্ধাশ্রমে গেলে দেখা যায় সন্তানদের জন্য মায়ের বুক ভাঙা কান্না। খোকার মুখখানি একবার দেখার জন্য জানালার পাশে বশে কতই না অপেক্ষা। যে মা শত কষ্ট সহ্য করে, নিজে খেয়ে না খেয়ে আমাকে মানুষ করেছে সে মাকে রেখেছি বৃদ্ধাশ্রমে।
আরও পড়ুন>>>যে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া
পিতামাতার সেবা যত্ন, খোঁজ খবর শুধু এক দিনের জন্য নয় বরং সারা জীবনভর সেবা করার শিক্ষা সৃষ্টিকর্তা আমাদের দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক একমাত্র তারই ইবাদত করার ও পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার তাগিদপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। তোমার (জীবদ্দশায়) তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিসূচক ‘উহ’-ও বলো না এবং তাদেরকে বকাঝকা করো না, বরং তাদের সাথে সদা বিনম্র ও সম্মানসূচক কথা বলো। আর তুমি মমতাভরে তাদের উভয়ের ওপর বিনয়ের ডানা মেলে ধর। আর দোয়ার সময় বলবে,
হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি সেভাবে দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমায় লালনপালন করেছিল। (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৩-২৪)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার একজন লোক মহানবির (সা.) কাছে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! মানবজাতির মধ্যে কোন ব্যক্তি আমার নিকট সদয় ব্যবহার ও উত্তম সাহচর্যের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত?’ উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবং তারপর?’ তিনি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘এবং তারপর’? তিনি (সা.) উত্তর দিলেন তোমার পিতা’। (বুখারি, মুসলিম) অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসুল! কোন ব্যক্তি আমার সাহচর্যের বেশি উপযুক্ত? তিনি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার পিতা, তারপর তোমার নিকটাত্মীয়গণ’ (বুখারি ও মুসলিম)।
আরেক হাদিসে মুসনাদে আহমাদে উল্লেখ আছে হজরত হাজেমা (রা.) নামক এক সাহাবি থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুল (সা.)-এর কাছে জিহাদে শরিক হওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য উপস্থিত হলাম। তখন মহানবি (সা.) বললেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম হ্যাঁ, তখন মহানবি (সা.) বললেন তুমি ফিরে যাও ও তোমার মাতার সম্মান এবং খেদমতে লেগে যাও। কেননা তার দু’পায়ের নিচেই বেহেশত রয়েছে।
শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী নারীদের মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহপাকের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘পুরুষরা যা অর্জন করেছে, এতে তাদের অংশ রয়েছে। আর নারীরা যা অর্জন করেছে এতে তাদের অংশ রয়েছে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাও। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে পুরোপুরি অবগত’ (সুরা আন নেসা, আয়াত : ৩৩)।
কর্মের ফলাফলের দিক থেকেও নারী-পুরুষের সমতাকে পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত আয়াতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখানে কাউকে কম-বেশি বলে উল্লেখ করা হয়নি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কোনো কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করব না, তা সে পুরুষ হোক বা নারীই হোক। তোমরা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯৬)। আবার বলা হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমি আদম সন্তানকে সম্মানে ভূষিত করেছি’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭১)। এ সম্মানে নারী-পুরুষ সমান অংশীদার। নারী-পুরুষে বা মানুষে-মানুষে সম্মানের পার্থক্যের কল্যাণ একমাত্র তাকওয়া বা আল্লাহকে মেনে চলা। যদি নারী পুরুষ অপেক্ষা অধিক মুত্তাকি হয়, তবে সে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।
পুরুষ বলেই কেউ নারী থেকে অধিক সম্মানিত হয় না। সব আদম সন্তানকে আল্লাহতায়ালা সমভাবে সম্মানিত করেছেন। কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করেননি। উপরিউক্ত আয়াত ধর্ম, বর্ণ, বংশ সব ভেদাভেদ শেষ করে দিয়েছে।
ইসলামি শরিয়ত নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান সামাজিক-মর্যাদা এবং অধিকার দিয়েছে। কোনো নারী যদি আশ্রয়হীন বা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সে তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজন পূরণ এবং স্বীয় সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে হালাল উপায়ে কামাই-রোজগার করতে পারে। এ জন্য সব রকম বিধিসম্মত উপায়ও সে অবলম্বন করতে পারে। নারী পর্দা করে ব্যাবসাবাণিজ্য এবং সম্পদ-সম্পত্তি থাকলে সেসবের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও তদারকির জন্যও বাইরে যেতে পারে।
ইসলাম নারীকে তার পিতা-মাতা, স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি লাভের অধিকারও দিয়েছে। নারী তার স্বামীর কাছ থেকে নির্ধারিত ও সম্মানসূচক অতিরিক্ত আর্থিক নিশ্চয়তাস্বরূপ মোহরানার অধিকারী। নারী বিয়ের আগে অভিভাবক ও বিয়ের পরে স্বামীর কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে ভরণপোষণের অধিকারী। ব্যবসায়ে নিয়োজিত অর্থ, নিজ পরিশ্রমের অর্থ ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সব সম্পদে নারীর আইনগত মালিকানা স্বীকৃত। তালাকের ব্যাপারে স্বামীর যতটুকু অধিকার রয়েছে, স্ত্রীরও ঠিক ততটুকু অধিকার রয়েছে। স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে সব সময়ই বৈবাহিক-অধিকার দাবি করতে পারে।
ইসলাম পুরুষের মতো নারীকেও সমানভাবে আধ্যাত্মিক উন্নতি-উৎকর্ষ সাধনের অধিকার দিয়েছে। ইসলামের বিধিবিধান পালন করা যেমন পুরুষের কর্তব্য, তেমনি নারীও যদি এ বিধিবিধান মেনে চলে, তবে ফল লাভের অধিকার সমান। আধ্যাত্মিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা হয়নি।
পবিত্র কুরআন ও মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত, নারী ও পুরুষ এক ও অভিন্ন জীবনসত্তা থেকে সৃষ্ট। সৃষ্টিগত দৃষ্টিকোণে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ বা বৈষম্য নেই।
আবার ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশস্বরূপ। যেমন- মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, তারা হলো তোমাদের পোশাক এবং তোমরা হলে তাদের পোশাকস্বরূপ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)। এই একটি আয়াতের মাধ্যমেই কতই না চমৎকারভাবে একটি মাত্র বাক্যে পবিত্র কুরআন স্ত্রী-লোকের অধিকার ও মর্যাদা বর্ণনা করেছে। বিভিন্ন সমাজ ও ধর্মে নারীর অবস্থান দৃষ্টে এটাই প্রতীয়মান হয়, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে নারীকে এরূপ সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হয়নি।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ওপর থেকে জীবন পরিচালনার তৌফিক দিন, আমিন।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।