ফাইল ছবি
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ এক বহুমাত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের আচরণগত ত্রুটি বহুদিনের পুরনো সমস্যা হলেও করোনা-পরবর্তী সময়ে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন এক অদৃশ্য ভারে নুয়ে পড়েছে।
শ্রেণিকক্ষ, যে স্থান হওয়ার কথা জ্ঞানের আলো ছড়ানোর। আজ অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হচ্ছে ভয়ের নামান্তরে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের টানাপোড়েন এতটাই প্রকট হয়েছে যে, এটি এখন কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংকট নয়—বরং জনদুর্ভোগের চেহারা ধারণ করেছে।
করোনা মহামারি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভঙ্গুর বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীরা যখন আবার ক্লাসে ফিরল, তারা নিয়ে ফিরল ভয়, একাকিত্ব আর আত্মবিশ্বাসহীনতা। তখন দরকার ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সহমর্মিতা, স্নেহ, বোঝাপড়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল—ক্লাসরুমে শাসনের নামে তিরস্কার, শারীরিক ও মানসিক শাস্তি, এবং অবজ্ঞার ধারাবাহিকতা। কোমল শিশুমনে এ আঘাত শুধু তাদের পড়াশোনার আগ্রহই নিভিয়ে দিচ্ছে না, ভেতরে ভেতরে গড়ে তুলছে ভীত, হতাশ ও ভঙ্গুর এক প্রজন্ম।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানায়, ক্লাসে প্রশ্ন করলে অনেক সময় শিক্ষকরা বিরক্তি প্রকাশ করেন বা অপমানজনক মন্তব্য করেন। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকের পক্ষপাতমূলক আচরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কেউ ভালো রেজাল্ট করলেও তেমন উৎসাহ পায় না, আবার কেউ সামান্য ভুল করলে কড়া তিরস্কারের শিকার হয়।
সরকার ইতোমধ্যেই বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এ নীতির কার্যকারিতা এখনো তেমন চোখে পড়ে না। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকরা বলছেন, শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা শিখতে পারবেন কীভাবে শিক্ষার্থীদের প্রতি ইতিবাচক আচরণ প্রদর্শন করতে হয় এবং কীভাবে শাসনের বদলে উৎসাহের মাধ্যমে শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়া যায়।
আরও পড়ুন< এম গোলাম মোস্তফা ভূইয়ার লেখা> বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চক্রে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। এর ফলে শিক্ষার মান ক্রমাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও।
শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের অভিযোগ বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। যোগ্যতার চেয়ে টাকা বা প্রভাবশালী পরিচয় অনেক সময় বেশি প্রাধান্য পায়। এতে প্রকৃত মেধাবীরা শিক্ষক হতে না পারলেও অনেকে টাকার বিনিময়ে পদে বসে যাচ্ছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার গুণগত মানে।
অন্যদিকে বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো নির্মাণ, পাঠ্যবই সরবরাহ এবং শিক্ষা সামগ্রী কেনাকাটার ক্ষেত্রেও অনিয়ম দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার না হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে গায়েব হয়ে যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হয়।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অনিয়ম, কোচিং ব্যবসার দৌরাত্ম্য এবং প্রাইভেট টিউশনের ওপর অযৌক্তিক নির্ভরশীলতা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করছে। শিক্ষকরা অনেক সময় শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর বদলে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে পাঠাতে উৎসাহিত করেন, যা এক ধরনের নৈতিক স্খলনও বটে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা জরুরি। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।
শিক্ষা কেবল একটি জাতির উন্নয়নের হাতিয়ার নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের প্রধান ভিত্তি। তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ না হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অধিকিন্তু, এখানে শিক্ষকদেরও বাস্তবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একজন শিক্ষককে যেখানে সর্বোচ্চ ৩০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নেয়ার কথা, সেখানে তিনি পড়াচ্ছেন ৫০–৬০ জনকে। আবার যেখানে একটি বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষক থাকার প্রয়োজন, সেখানে আছেন মাত্র ১২ থেকে ১৫ জন শিক্ষক। ফলে একজন শিক্ষককে দিনে তিনটি ক্লাস নেয়ার বদলে পাঁচ থেকে ছয়টি ক্লাস নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে, আধুনিক শিশু মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের অভাবে তারা শিক্ষার্থীদের ভেতরের সংকট তেমন বুঝতেও পারছেন না।
উপরন্তু শিক্ষাদানের মূল কাজ ফেলে তাদের করতে হচ্ছে নানা ধরনের প্রশাসনিক কাজ-পরিসংখ্যান সংগ্রহ, ভোটের দায়িত্ব, সরকারি প্রকল্পের কাগজপত্র ইত্যাদি। ফলে ক্লাসরুমে শিক্ষক ক্লান্ত, অনুৎসাহী ও মানসিকভাবে চাপে থাকছেন নিত্যদিন। সেই চাপ, ইচ্ছাকৃতভাবে হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীর ওপর আচরণগত ত্রুটি হিসেবে পড়ে যায়।
আরও পড়ুন< ধ্রুব আহসানের লেখা> চিরঞ্জীব হুমায়ূন আহমেদ
এর সঙ্গে যুক্ত আছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা- এসব কেবল রাস্তাঘাটে অচলাবস্থা সৃষ্টি করছে না, সরাসরি আঘাত করছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রায়শই স্কুল-কলেজ বন্ধ, পরীক্ষা অনিশ্চিত। আর অনিশ্চয়তার ভয়াবহ চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক জগৎকে ক্ষতবিক্ষত করছে। যে বয়সে স্বপ্ন দেখার কথা, সে বয়সে তারা দেখছে অনিশ্চয়তার অন্ধকার।
আরেকটি ভয়াবহ বাস্তবতা হলো- দেশীয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্নতা। গান, নাটক, বিতর্ক, ক্রীড়া কিংবা আবৃত্তি—এসব ছিল আমাদের প্রজন্মকে গড়ার প্রাণশক্তি। এখন বিদ্যালয়ের মাঠ নিস্তব্ধ, মঞ্চ ফাঁকা, মাইক নীরব। যে সৃজনশীলতা একদিন জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাত, তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষার খাতায় নম্বর তোলার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে।
একজন শিক্ষক যদি সন্তানসম স্নেহ নিয়ে শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ান, তবে সে শিক্ষার্থী সারা জীবন প্রেরণা খুঁজে পায়। আর যদি শিক্ষক অবহেলা, অপমান বা পক্ষপাত দেখান, তবে সে ক্ষত কখনোই মুছে যায় না। আজকের সংকট তাই শুধু বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি গোটা সমাজ, গোটা জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
এখনই যদি আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ককে মানবিক করার দিকে নজর না দিই, যদি আমরা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রাণ ফিরিয়ে না আনি, যদি আমরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করি—তবে শিক্ষা ব্যবস্থার এ ভাঙন একদিন জাতির ভাঙনে রূপ নেবে।
শিক্ষক যদি অনুপ্রেরণা না হন, যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভরসার জায়গা না হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না হয়- তবে জাতির ভবিষ্যৎ কোন আলোয় এগোবে? এ ভয়ঙ্কর প্রশ্ন আজ আমাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































