
ফাইল ছবি
চট্টলগর্ব উপমহাদেশের সিংহপুরুষ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনিই সম্ভবত একমাত্র আলেম এবং বাঙালি নেতা, যিনি মুসলিম লীগ না করে কংগ্রেস করেছেন এবং পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেননি।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আমরা আরেকজন মুসলমান নেতা ও মাওলানাকে পাই, যিনি শুধু কংগ্রেসই করেননি, বরং কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, কাজেম আলী মাস্টার, শাহ বদিউল আলম প্রমুখ রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম লীগ করেননি, কিন্তু তারা মাওলানা ছিলেন না। মাওলানা ইসলামাবাদী ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসে যোগদান করেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেন বিশ শতকের প্রারম্ভে চট্টগ্রামে নানা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ আদেশ ঘোষিত হতে না হতেই বাংলাদেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। দেশের প্রান্তীয় জেলা চট্টগ্রাম জেগে ওঠে আন্দোলনের তরঙ্গাভিঘাতে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সফরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন তুমুল গতিবেগ অর্জন করে আছড়ে পড়ে বন্দরনগরীতে। তখন বাঙালি পরিচয় ছিলই মুখ্য, হিন্দু -মুসলমানের কোনো প্রশ্ন ছিল না। হিন্দু নলিনীকান্ত-যামিনীকান্ত ভ্রাতৃদ্বয়, দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্তের পিতা যাত্রামোহন সেন, কবি শশাঙ্কমোহন সেন ও বিপিন বিহারী নন্দী, চট্টল গৌরব মহিন চন্দ্র দাশ, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী, অম্বিয়া চক্রবর্তী, শিখ মোহন্ত কৃপাল দাস উদাসী, মুসলিম শেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, তদীয় পুত্র শের-ই-চাটগাম একরামুল হক, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, আমানত খান, জালাল আহমদ জগলুল হাত-ধরাধরি করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। আন্দোলনে সাময়িক ছেদ পড়ে। পরে দেখা গেল সেটা ছিল আরও বড় আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্য সাময়িক বিরতি।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেবার গান্ধীজি আফ্রিকা থেকে এসে ভারতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার জে এম সেনগুপ্তও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়ে সৈনাপত্য গ্রহণ করেন। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ডামাডোল বেজে ওঠে। কাজেম আলী মাস্টার, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন সে আন্দোলনে জে এম সেনগুপ্তের উপদেষ্টা। মহিমচন্দ্র দাশ ও ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী ছিলেন প্রধান সহযোগী। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট করে। জে এম সেন হলে ধর্মঘটি ছাত্র ও জনসাধারণের বিরাট জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।
আরও পড়ুন<<>>এম গোলাম মোস্তাফার লেখা<<>> বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
একই বছর কলকাতায় আহূত ভারতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন যোগদান করেন ইসলামাবাদী। তিনি বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি ও কৃষক প্রজা পাটির সহসভাপতির পদ অলংকৃত করেন। নিখিল বঙ্গ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। এরপর ইসলামাবাদী সংসদীয় রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। প্রথমে তিনি জেলা বোডের সদস্য, ১৯৩৭-এর নির্বাচনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ (মধ্য) নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অসারতা প্রতিপন্ন করে আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ রচনা (১৯৪২-১৯৪৩) করেন। ত্রিশের দশকে তিনি বঙ্গীয় কৃষক-প্রজা দলে যোগদান করেন।
মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। ইসলামাবাদীর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগদান ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থনে এগিয়ে এসে। ১৯৪২-৪৩ সালে নেতাজির সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তিনি ইস্টার্ন জোনের (বর্তমান বাংলাদেশ ও আসাম) প্রধান সংগঠক ও সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। নেতাজির চট্টগ্রাম সফরকালে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় দেয়াং পাহাড়ে মাওলানা ইসলামাবাদীর সঙ্গে তার গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় ইসলামাবাদী সেখানে ইসলাম মিশন এতিমখানা শাখা, পশুপালন খামার, মত্স্য খামার, কৃষি খামার এবং জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তার আগে মাওলানা ইসলামাবাদী তার পৈতৃক সম্পত্তি হস্তান্তর করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী এবং ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের গোপন দুর্গ হিসেবে বিপুল জায়গাজমি নিয়ে এক খামারবাড়ি স্থাপন করেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার দায়ে ১৯৪৪-এর ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন। এক বছর (১৯৪৪-৪৫) লাহোর সেন্ট্রাল জেলে আটক ছিলেন।
মাওলানা ইসলামাবাদী নারী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বাংলার মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা ও কল্যাণের পথে আহ্বান জানিয়ে ‘আল এসলাম পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘যখন পুত্র কন্যার মা হইবে, তখন সর্বদা তাহাদিগকে শুধু অলংকার পরাইবার চেষ্টায় লাগিয়ে থাকিও না। যে অলংকার স্থায়ী নহে, তাহাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিও, সভ্যতা শিক্ষা দিও।’
কর্মবীর দেশপ্রেমিক এ নেতা সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একেবারে নীচের ধাপ থেকে যেখানে রয়েছে দেশের ও অর্থনীতির মূল শেকড়। তাই ইসলামাবাদীর একদিকে যেমন কাম্য ছিলো কৃষক শ্রমিকের উন্নতি তেমনি যেসব অত্যাবশ্যকীয় বৃত্তির প্রতি মুসলিম সমাজের অনীহা ছিলো, তিনি চেয়েছিলেন তার প্রতিও মুসলিম সমাজকে আগ্রহী করে তুলতে। তিনি প্রায় বলতেন, মুসলমানরা যদি কর্মকার, কুম্ভকার, গোয়ালা, ময়রা বাবুজীবীর ব্যবসায় অবলম্বন করে তাহাও দেশেরই সেবা। ইহাতে হিন্দুদের অসন্তোষের কোন কারণ নাই। (ড. আবদুল গফুর সিদ্দিকী)।
মাওলানা ইসলামাবাদীর গভীর আস্থা ছিলো আলেম সমাজের উপর। এটি তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম সমাজের প্রতিদিনকার জীবনাচরণ অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও প্রতিদিনকার অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যার পরিচালক স্বভাবতই আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা হিসেবে জনসাধারণের উপর যাদের প্রভাব অপরিসীম। এ আলেম সমাজকে যদি সংঘবদ্ধ করে দেশ সমাজের আশু সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে তোলা যায়, তাহলে এদের দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যাবে। মুসলমান সমাজ যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন আর যেসব অন্তহীন বাধা-বিপত্তি সমাজকে পংগু আর নির্জীব করে রেখেছে ইচ্ছা করলে এরাই তার বন্ধন থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে পারে। (কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল) আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙালাহ’ এ পরিকল্পনারই বাস্তব রূপ। সংগঠনটির মুখপত্র আল এসলাম-মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত প্রথম স্বাধীন পত্রিকা, যা ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন<<>>ফৌজিয়া রুবির লেখা<<>> শিক্ষক-শিক্ষার্থী টানাপোড়েন : জাতীয় ভাঙনের পূর্বাভাস
একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিলো তার আমৃত্যু। ‘তার আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিলো ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের প্রসারের সাথে সাথে তাদের পরিশ্রমী, সংযমী ও স্বাধীনতাকামী করে গড়ে তোলা এবং এভাবে সমাজ ও দেশের বৃহত্তর কর্তব্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়া। (শামসুজ্জামান খান- মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী) এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সাথে কারিগরি ট্রেনিং ও হাঁস-মুরগির খামার নির্মাণ প্রকল্পসহ বাস্তব জীবনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চট্টগ্রাম শহরের অদূরে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব দক্ষিণ তীরবর্তী সুপ্রাচীন বন্দর শহর দেয়াং। এর পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে মতবিরোধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাকিস্তান আন্দোলনসহ নানা ঘটনা পরম্পরায় আরবি বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এ নিয়ে আমৃত্যু আক্ষেপ ছিলো তার।
চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামের এক প্রখ্যাত আলেম পরিবারে ১৯৮৫ সালে এ মনীষীর জন্ম। তার বাবা মুন্সী মতিউল্লাহ্ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপন্ডিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সুপণ্ডিত বাবার তত্ত্বাবধানে শিক্ষা জীবন শুরু করে পরবর্তীতে হুগলী ও কলকাতা মাদ্রাসা আলিয়া থেকে জমাতে উলা বা টাইটেল পাস করে মওলানা উপাধি লাভ করেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন রংপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। রংপুর থাকাকালে ভারত উপমহাদেশ ও এর বাইরের দেশে বহু জ্ঞানী গুনী মানুষের সংস্পর্শে এসে মওলানা মনিরুজ্জামানের ভেতরে এ চেতনার উন্মীলন ঘটে যে, অবিভক্ত বাংলার সাধারণ মুসলিম জনগণের অন্ধত্ব, অশিক্ষা, গোঁড়ামি, দারিদ্রত্যা দূর করতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তার প্রয়াস প্রচেষ্টায় উত্তরবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা। চট্টগ্রামের কদম মোবারক মুসিলম এতিমখানা, কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় ও বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান।
মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য এবং তাদের মধ্যে আত্মসচেতনাবোধ সৃষ্টির মানসে তিনি ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন। জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় তিনি ৪২ টির মত গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ১. ভারতে মুসলিম সভ্যতা ২. সমাজ সংস্কার ৩. ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান ৪. ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান ৫. ভারতে ইসলাম প্রচার ৬. সুদ সমস্যা ৭. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান (৩ খন্ডে) ৮. ইসলামী শিক্ষা ৯. কুরআন ও বিজ্ঞান ১০. আত্মজীবনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।
এ মণিষীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং মহান রবের দরবারে তার জন্য দোয়া করি তিনি যেন জান্নাতবাসী হয়ে থাকেন।
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।