
ফাইল ছবি
বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির কারণ ফারাক্কা বাঁধ। পদ্মা নদীর উজানে ভারতের গঙ্গায় নির্মিত এ বাঁধ চলতি মে মাসে পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে। দীর্ঘ এ সময়ে বাঁধটি আন্তঃসীমান্ত নদীর গতিপথে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের পদ্মাসহ এর শাখা নদ-নদীর ওপর। ভারতে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পদ্মায় চর জেগেছে, শুকিয়ে মরে গেছে এ নদীর উৎস থেকে সৃষ্ট পাগলা, মহানন্দা, পুনর্ভবা নদী। মৃত্যুপ্রায় কপোতাক্ষ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার নদ-নদী।
যে কারণে গত অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ ছিল এ ফারাক্কা নিয়ে। অপরদিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না! ফারাক্কা চালু হওয়ার দু'দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬তে ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল।
তিরিশ বছর মেয়াদি সে চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে, চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কিন্তু কখনওই থামেনি। তবে ফারাক্কার জন্যই পদ্মার দু'কূলে মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন বলে যেমন বাংলাদেশের অভিযোগ – তেমনি ভারতেও কিন্তু ফারাক্কার সমালোচনা কম নয়।
যেমন মাত্র কয়েক বছর আগেই ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেয়ারও দাবি তুলেছিল বিহার সরকার, যে রাজ্যটির অভিযোগ প্রতি বছর ফারাক্কার কারণেই তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাঁটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা। তা ছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞই মানেন কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা – যে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আর একটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।
আশির দশকে ফারাক্কাতে এনটিপিসি-র যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, তারাও ব্যবহার করে এ ক্যানালের জল। ভাঁটির দিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তারাও এ জলের ওপর নির্ভরশীল। সব মিলিয়ে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধ ও খালই নয়, এ প্রকল্পকে ঘিরে গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট ক্যানভাসই আঁকা হয়ে গেছে বলা চলে – যাকে বিশেষজ্ঞরা 'ফারাক্কা ইকোসিস্টেম' নামে বর্ণনা করে থাকেন।
ফারাক্কার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ভারতেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান ছিলেন। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে সে সব আপত্তি বিশেষ ধোপে টেঁকেনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী, কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরবর্তী জীবনে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও। ১৯৮৯ সালে মি ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ২৭ বছর পর, ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকার ফারাক্কা বাঁধ 'তুলে দেয়ার জন্য' কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়। তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে – অতএব বাঁধটাই তুলে দেয়া হোক!
বিহারের আহমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ শেখের কথায়, বর্ষার সময় ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়া উচিত, নইলে বিহারবাসীর খুব দুর্দশা! অথচ বর্ষার সময়ই গেট বন্ধ রাখে, নদী ওভারফ্লো করলে তখনই গিয়ে গেট খোলে – যখন বিহার ডুবে গেছে!
বর্ষার মৌসুম এলেই যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে বিহার একটু স্বস্তি পাবে! ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায়, গঙ্গাতীরের লাধোপাড়া গ্রামের মিশির শেখ আবার বলছিলেন, রাজমহলের ওপারে গঙ্গা যদি দেখেন – গরমে নদী তো একদম শুকিয়ে যায়!
ফারাক্কা বাঁধে বাংলাদেশের নদ-নদীতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তার বড় সাক্ষী পদ্মাপাড়ের মানুষ। ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত পানি সরিয়ে নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে মারাত্মক পানি সংকটে ভুগছেন তারা। আবার বর্ষাকালে সেই ফারাক্কারই সব গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রায় প্রতি বছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা ও ভাঙনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছরই বাস্তুচ্যুত হচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষ।
৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টনচুক্তির মেয়াদও ২০২৬ সালে ফুরিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্কে এই চুক্তি নবায়ন হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তিটি নবায়ন হলেও আগের মতো করে পানি ভাগাভাগি হবে কি না এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। গঙ্গা নদী পানির ন্যায্য হিস্যা ভবিষ্যৎ পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ধারণ করবে।
নদী গবেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘতম এ নদীর গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদ-নদীর প্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করেছে ফারাক্কা। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা যায় ধু ধু বালুচর। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা, দর কষাকষি, নদীর অববাহিকা চুক্তি সম্পাদনে রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত আন্তজার্তিক সনদে বাংলাদেশ এখনও অনুস্বাক্ষর করেনি। দ্রুতসময়ে অনুস্বাক্ষরের পরামর্শ তাদের।
ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ ও মুর্শিদাবাদ এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি বাঁধ। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার জল নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা নদী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এ নদীটি রাজশাহী বিভাগ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে অচলাবস্থায় ভাটির দেশেরই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। গঙ্গার উজানের বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান হারে পানি প্রত্যাহার ছাড়াও তলে তলে চলছে সর্বনাশা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের খণ্ড খণ্ড বাস্তবায়ন। ওদিকে সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত নদী ব্রহ্মপুত্রে চীন যেমন একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তেমনই ভারত শুরু করেছে একাধিক জলাধার ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের তোড়জোড়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গঙ্গা ও তিস্তার পর ব্রহ্মপুত্রেও অনিবার্যভাবে দেখা দেবে প্রবাহস্বল্পতা। যত দিন যাবে, পরিস্থিতির অবনতিই হতে থাকবে।
ফারাক্কার ভবিষ্যত ঠিক কোন পথে, তা এখনও কারও জানা নেই, কিন্তু এটা বলা যায়, ফারাক্কাকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় পরের ৫০ বছর ধরেও চলবে!
সূত্র: বিবিসি বাংলা
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।