Apan Desh | আপন দেশ

মার্জ করতে শরীয়াহভিত্তিক ৫ ব্যাংকে বসছে প্রশাসক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:৪১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মার্জ করতে শরীয়াহভিত্তিক ৫ ব্যাংকে বসছে প্রশাসক

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতের শরীয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত (মার্জ) করার সিদ্ধান্ত নওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক বসানো হবে। একীভূত হওয়ার পর পাঁচটি ব্যাংক বিলুপ্ত হয়ে একটি নতুন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের নামে সম্পদ ও দায় স্থানান্তরিত হবে।

নতুন ব্যাংক শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন

মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, নতুন ব্যাংকটি হবে শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। অর্থাৎ একীভূত হওয়ার পর আর বেসরকারি মালিকানার কোনো ব্যাংক থাকছে না। সম্পূর্ণভাবে সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে নতুন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক। তিনি আরও বলেন, প্রশাসক বসানোর মাধ্যমে একটি টিমওয়ার্ক তৈরি করা হবে। প্রশাসক সব কিছুর সঙ্গে সমন্বয় করবেন। ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার পর তাদের সহযোগিতার জন্য একটি টিম গঠন করা হবে। সে টিম ব্যাংকের দৈনন্দিন পরিচালনাগত সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে কাউকে সরানো হচ্ছে না, তবে নির্বাহী ক্ষমতা তাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে প্রশাসকের হাতে দেয়া হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুরোধে এমডিদের অপসারণ বা নিয়োগ বাতিলও করা যেতে পারে।

মার্জ হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এখনও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কবে নাগাদ প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে। কাদের নাম চূড়ান্ত হবে। এ বিষয়ে নাম প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিবিভাগ, পরে গভর্নর অনুমোদন দেবেন।

ব্যাংক খাত সংস্কার ও খেলাপির চিত্র

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান দিয়ে পাঁচ ব্যাংকের সম্পদের মান যাচাই করেছে। অ্যাসেট কোয়ালিটি রিপোর্ট (একিউআর) অনুযায়ী দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত খেলাপির পরিমাণ ৭৭ শতাংশেরও বেশি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের খেলাপি ৩০ শতাংশের বেশি হলে সেটি অবলোপন বা পুনর্গঠনের উপযুক্ত ধরা হয়। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মুখপাত্র জানান, প্রশাসকদের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের সঠিক চিত্র চিহ্নিত করা হবে। টাক্সফোর্সের নির্দেশনায় সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রশাসকরা সরকারের গঠিত ব্যাংক খাত সংস্কার টাক্সফোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন।

আপত্তি ও ভিন্নমত

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবুও এর বিরোধিতা করছে এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এ দুই ব্যাংকের পরিচালকরা মনে করেন, তাদের আরও কিছু সময় দিলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। এমনকি গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন পরিচালক নিয়োগ পাওয়ার পর তারা একটি বিস্তারিত পুনর্গঠন পরিকল্পনা জমা দিয়েছিল।

তাদের দাবি, সরকারের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। তবে নীতিনির্ধারক মহল বলছে, শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়- ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থাই বলে দিচ্ছে, অবস্থা খুবই নাজুক।

সরকারের আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা

পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার জন্য সরকার প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল বরাদ্দের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ জন্য অর্থমন্ত্রণালয় একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে এই কমিটিই নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স সংগ্রহ করবে।

নতুন ব্যাংকের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, নামকরণে ইসলামী ব্যাংকিং ও শরীয়াহভিত্তিক অর্থনীতির বিশেষ পরিচিতি বহন করবে। প্রশাসক নিয়োগের পর থেকে ব্যাংকগুলো কার্যত অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে ভুগছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ ও দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অনেকেই রাজনৈতিক নিয়োগ ও দুর্বল শাসন ব্যবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি প্রশাসকদের মাধ্যমে সঠিক সংস্কার না হয়, তবে নতুন ব্যাংকও আগের মতো সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়েছে, তারা ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাইছে। শরীয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে নতুন একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ সে প্রচেষ্টার অংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—প্রশাসকদের নেতৃত্বে এ ব্যাংকগুলো কতো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং সাধারণ গ্রাহকের আস্থা কতটা ফিরে আসবে।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়